অবহেলিত বাসচালক-হেলপাররা, চাকা ঘুরলেও ভাগ্য ঘোরে না

|

তাজনুর ইসলাম:

দিনের আলো ফোটার সাথে সাথেই বাসচালক জুয়েল রানা গাড়ির চাকা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। কারণ এই চাকা ঘুরলেই, তার জীবনের চাকা ঘুরবে। এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে হেলপারকে নিয়ে তার যাত্রা শুরু করেন তিনি।

ছোটবেলায় পরিবহন খাতে কাজ শুরু করেন জুয়েল। প্রায় দশ বছরের মতো বাস চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। যাত্রাপথে তার নানামাত্রিক অভিজ্ঞতার গল্প শোনান যমুনা টেলিভিশনকে।

চালক জুয়েল বলেন, বাসমালিকের সাথে চুক্তিবদ্ধ চালকদের আয়ের অধিকাংশ সড়কেই ব্যয় হয়ে যায়। ফলে মালিকের টাকা উঠিয়ে, নিজের জন্য উপার্জনে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। এছাড়া প্রতি মুহূর্তে মানুষের কথা শুনতে হয়। এরপরও দিনশেষে উপার্জন না হওয়ার চেয়ে কষ্টের কিছু নেই।

জুয়েল আরও বলেন, বাসমালিকের লক্ষ্য পূরণ করা, মালিক সমিতির টাকাসহ অন্যান্য খরচ পরিশোধ করতে হয়। এসব খরচ দেয়ার পর আর কিছুই থাকে না। অনেকসময় শুন্য হাতে বাসায় ফিরতে হয়।

এরকম অজস্র চাপ নিয়ে বাস চালান চালকরা। তবুও চালকের আসনে বসে সব ইন্দ্রিয় সজাগ রাখতে হয় তাদের। তবে নিজে সজাগ থাকলেও পাশের অন্য চালক হয়তো ভিন্ন আচরণ করেন। ওয়েবিলের টার্গেট, বেশি যাত্রী তোলার মানসিকতা ইত্যাদি নিয়ে প্রায়ই প্রতিযোগিতা লেগে থাকে। আবার অনেকেই স্বস্তি খোঁজেন মাদকে।

এ বিষয়ে চালক জুয়েল বলেন, সব চালক এ রকম নয়। কিন্তু অনেকে সবাইকে খারাপ ভাবে। অপর একজন চালক বলেন, অনেকে মনে করেন চালকরা নেশা করে, কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। রাতে না ঘুমানোর কারণে এরকম মনে হয়।

এদিকে বহুদিন ধরে আলোচনা চললেও পরিবহন শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় এখনও কোনো দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বাসচালদের অভিভাবক সংস্থাগুলো কি তাদের নিয়ে ভাবছেন?

অপরদিকে পুরো পরিবহন খাতটি বর্গা চাষের মতো। যেখানে মালিকের নিশ্চিত মুনাফা থাকে। আর শেষের লাভ বা ক্ষতিতে চালক-হেলপারের জীবন বাধা থাকে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি কোথায়?

চালক জুয়েল বলেন, সব খরচ শেষে বাস চালিয়ে মাসে দশ হাজার টাকাও উপার্জন করা যায়না। অপর এক চালক বলেন, পরিবারে সদস্য বেশি হলে, একজনের উপার্জন দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যায়।

আরেকজন বাসচালক বলেন, কোনোদিন ২০০ টাকা, ৫০০ টাকা উপার্জন হয়। কোনোদিন খালি হাতেই ফিরতে হয়। আবার কখনো বাসমালিক ও জ্বালানিতে ভর্তুকিও দিতে হয়। আরেকজন বলেন, নির্ধারিত বেতনের ব্যবস্থা থাকলে কোনো চিন্তা করতে হতো না। ফলে সড়কে হুড়োহুড়ি ও দুর্ঘটনা বন্ধ হতো।

অপরদিকে এ নিয়ে মালিক সমিতির বক্তব্য অন্যরকম। চালক আর সহকারীদের জীবনমান উন্নয়নে তাদের অনেক আন্তরিকতা রয়েছে বলে জানান তারা।

ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতি সিনিয়র সহ সভাপতি সফিকুল আলম খোকন বলেন, সরকার জায়গা বরাদ্দ দিলে বাস চালকদের জন্য নিজেদের খরচে একটি ইনিস্টিটিউট তৈরি করা হবে। বিষয়টি সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে মালিকের সহানুভূতি ও নিয়য়ন্ত্র সংস্থার নজরদারি দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, একদিন গাড়ি চালিয়ে অনেক চালকে বিশ্রাম নিতে হয়। অর্থাৎ একদিনের আয় দিয়ে তাদের দুইদিন জীবনযাপন করতে হয়। এখানে শ্রম ঘণ্টা নির্ধারিত না থাকা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং আয় ও জীবনমানের কোনো নিশ্চয়তা নেই। এক্ষেত্রে চালকদের চরমভাবে অবহেলা করা হচ্ছে। এ সময় স্বাধীনতার ৫০ বছরেও গণপরিবহনকে একটি সিস্টেমের মধ্যে আনা যায়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে রাত ফুরিয়ে মধ্যরাতে দিকে প্রায় ১৬ ঘণ্টা বাস চালিয়ে ১৩ হাজার টাকা আয় করেছে জুয়েল ও তার সহকারী। এর মধ্যে পরের দিনের জন্য তেল কিনতে খরচ হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা, মালিককে সাড়ে ৩ হাজার ও সড়কে আরও ৩ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। সব খরচ শেষে জুয়েল ও তার সহকারীর আয় মাত্র দেড় হাজার টাকা।

তারপরও ভাগ্য বদলের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। কিন্তু কোনোদিনই হয়তো তা আর বদলাবে না। এভাবেই প্রতিদিন তাদের আক্ষেপ জমতে থাকে।

/আরএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply