রোজারিও থেকে লুসাইল ‘চ্যাম্পিয়ন মেসির গল্প’

|

ছবি: সংগৃহীত

ইউসুফ ভূঁইয়া:

১৩ বছর বয়সে আর্জেন্টিনার রোজারিওতে স্বপ্ন বোনা, ৩৬ বছর বয়সে কাতারের লুসাইলে স্বপ্ন পূরণ। এই যেন এক রূপকথার গল্প। সেই রূপকথার গল্প লেখেছেন আর্জেন্টাইন ক্ষুদে জাদুকর লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে নিজ শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল, সে একদিন রাজত্ব করবে বিশ্ব ফুটবলে। বিশ্ববাসীকে চেনাবে নিজ শহরকে। অবশেষে তিনি চিনিয়েছেন। এমনভাবে চিনিয়েছেন যা বিশ্ববাসী কোনদিনই ভুলতে পারবে না।

‘সর্বকালের সেরা ফুটবলার’ হিসেবে পরিচিত আর্জেন্টাইন ফুটবলার লিওনেল মেসির ৩৭তম জন্মদিন আজ। ১৯৮৭ সালে আজকের এই দিনে আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে জন্মগ্রহণ করেন এলএমটেন। জর্জ মেসি ও সেলিয়া কুচিত্তিনির তৃতীয় সন্তান মেসি। পরিবারের থেকে উদ্বুদ্ধ হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আলাদা নেশা ছিল। বড় দুই ভাই রদ্রিগো ও মাতিয়াস আর তার চাচাতো ভাই ইমানুয়েন বিয়াঙ্কুকি, ম্যাক্সিমিলিয়ানো ছিলেন মেসির ফুটবল খেলার সঙ্গী। ৬ বছর বয়সে নিউওয়েলস অল্ড বয়েজ ক্লাবে যোগ দেন মেসি। সেখানে ৬ বছর খেলেন তিনি। এই ৬ বছরে প্রায় ৫০০ এর অধিক গোল আসে তার পা থেকে। আর সেই সুবাদে তখন তার নাম হয় ‘৮৭ এর গোল মেশিন’।

১০ বছর বয়সে গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি নামক এক রোগ বাসা বাধে তার দেহে। যে কারণে থমকে যায় তার দেহের বৃদ্ধি। প্রতিমাসে তার এই রোগের চিকিৎসার জন্য খরচ হতো ১ হাজার ডলারের বেশি। প্রথমে তার ক্লাব নিউওয়েলস সেই খরচে অংশীদার হতে চাইলেও পরে হাত গুটিয়ে নেয় তারা। পরে রিভারপ্লেট ক্লাব তাকে দলে ভিড়িয়ে চিকিৎসা খরচ বহন করতে চাইলেও শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে যায় তারাও। যে কারণে শঙ্কা দেখা দেয় মেসির বেড়ে ওঠা নিয়ে। ১৩ বছর বয়সে মেসির পরিবার ও মেসি বার্সেলোনায় চলে আসে, যেখানে ক্লাব কর্তৃপক্ষ মেসির গ্রোথ হরমোনের ঘাটতির চিকিৎসায় তাকে সহায়তা করে। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে বার্সেলোনা তার জুনিয়র দলের জন্য মেসির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়।

বার্সেলোনার অনূর্ধ্ব-১৪ দলের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন এই আর্জেন্টাইন। তিনি তার অসাধারণ প্রতিভা এবং দক্ষতা দিয়ে সবার উপর ছাপ রেখে দ্রুত এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ১৭ বছর বয়সে এস্পানিওলের বিপক্ষে সিনিয়র হিসেবে ক্লাবে অভিষেক করেন এবং ব্লাউগ্রানারা (বার্সেলোনার অন্য নাম) তার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। ৩৭ বছর বয়সী এই খেলোয়াড় সেই সময় প্রতিযোগিতায় উপস্থিত হওয়া দলের সর্বকনিষ্ঠ তারকা হয়েছিলেন।

মেসি স্প্যানিশ ক্লাবটির হয়ে ১৭ বছর খেলেছেন, এই সময়ে তিনি ১০টি লা লিগা শিরোপা, ৪টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা এবং ৭টি কোপা দেল রে শিরোপা জিতেছেন। লা লিগায় ৪৭৪ গোল করে লিগের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন তিনি।

২০০৭ সালে দিয়েগো ম্যারাডোনার শতাব্দীর সেরা গোলটি অনুকরণ করে পুরো বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন মেসি। কোপা দেল রের সেমিফাইনালের প্রথম লেগে ক্যাম্প ন্যু’তে গেটাফের বিপক্ষে ম্যাচে গেটাফের ছয় ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ড্রিবল করে গোল করেন এই ফুটবলার।

২০০৯ সালে মেসি তার প্রথম উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতেছিলেন। ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ২-০ গোলে হারিয়েছিল বার্সেলোনা। ফাইনালে আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক হেডারের মাধ্যমে এই ম্যাচে একটি গোল করেন।

২০২০ সালে রিয়াল ভায়াদোলিদের বিপক্ষে বার্সেলোনার ৩-০ গোলের জয়ে লিওনেল মেসি তার ৬৪৪তম গোল করেছিলেন। তাতে করে এক ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভেঙে দেন মেসি। সান্তোস এফসির হয়ে ৬৪৩ গোল করা কিংবদন্তি ব্রাজিলিয়ান পেলে আগের রেকর্ডের মালিক ছিলেন।

আর্জেন্টিনার এই জাতীয় খেলোয়াড় ফরাসি লিগের ক্লাব প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইতে যোগ দিয়েছিল। ২০২১-২০২৩ সাল পর্যন্ত ক্লাবটির হয়ে খেলেছেন। তিনি মোট ৫৮ টি ম্যাচ খেলেছিলেন যেখানে তিনি দলের হয়ে ২২ টি গোল করতে পেরেছিলেন।

২০২৩ সালে ডেভিড বেকহ্যামের মালিকানাধীন ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেন মেসি। এখন পর্যন্ত ১৮টি ম্যাচ খেলে ১৩টি গোল করেছেন তিনি।

এর আগে, ২০০৫ সালের আগস্টে ছিল মেসির প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। হাঙ্গেরির বিপক্ষে আহত খেলোয়াড়ের যায়গায় স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। তবে, তার দুঃখজনক আন্তর্জাতিক অভিষেকটি স্বল্পস্থায়ী ছিল, কারণ তিনি ভিলমোস ভানজাককে আঘাত করার কয়েক মিনিট পরে বিদায় নিয়েছিলেন।

২০০৫ সালে ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে তার গোলে শিরোপা জেতে আর্জেন্টিনার বয়সভিত্তিক দলটি। ২০০৬ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে নেমেই পেয়েছিলেন গোলের দেখা। ২০০৮ সালে আর্জেন্টিনাকে অলিম্পিকের স্বর্ণ এনে দিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে।

২০২১ কোপা আমেরিকার ফাইনালে মারাকানা স্টেডিয়ামে ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল আর্জেন্টিনা। এই জয়ের মধ্য দিয়ে মেসির প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপার দীর্ঘ অন্বেষণের অবসান ঘটান।

২০২২ সালে কাতারে লিওনেল মেসির জেতা ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি ছিল তার ক্যারিয়ারের হাইলাইটস। ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে জোড়া গোল করেন মেসি। ৩৬ বছর পর পেনাল্টি শুটআউটে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। সে সময় জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার পিটার ড্রুরি বলেছিলেন, ‘লিওনেল মেসি হ্যাজ শেকেন হ্যান্ডস উইথ প্যারাডাইস।’ ফুটবলে অমরত্ব অর্জনের পর হয়তো মেসি সেদিন ঠিকই স্বর্গের দুয়ারে হাত রেখেছিলেন।

মেসি যখন ৩৬ পেড়িয়ে ৩৭টি বসন্তে পা রাখলেন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলছে দক্ষিণ আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই (কোপা আমেরিকা)। ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় সর্বজয়ী ফুটবলের এই মহানায়ক শুধুই উপভোগ করছেন ফুটবলকে। সেটা তো ভক্তদের প্রত্যাশা। তিনি যতদিন মাঠে থাকবেন, ততদিন ভক্তরাও উপভোগ করবেন তার খেলা। ভক্তরা তো প্রত্যাশা নিয়ে বসে আছে ২০২৬ বিশ্বকাপে মাঠে দেখতে পাবেন তাদের ফুটবল জাদুকরকে। বয়সটা এখন ৩৭ সেটাও বুঝতে হবে, সময় হয়তো বলে দিবে সেই উত্তর।

পরিশেষে, জন্মদিনে ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তিকে টুপি খোলা শুভেচ্ছা।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply