জাতীয় নাগরিক কমিটি: পথ খুবই কঠিন কিন্তু সম্ভাবনা দেখছি

|

মাজুল হাসান

রাষ্ট্র সংস্কার ও পুনর্গঠনের লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হলো ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’। এর পেছনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রয়েছে, তা স্পষ্ট। শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর অনেকের মনে উঁকি দিচ্ছিল— ছাত্ররা দল করবে কি না সেই প্রশ্ন। এর উত্তর এখনও ঝাপসা। তবে জাতীয় নাগরিক কমিটির আত্মপ্রকাশে আপাতত পরিষ্কার হলো, তাদের রাজনৈতিক অভিপ্সা। তারা এখন চাপ সৃষ্টিকারী দল হতে চাইছেন, যদিও আবরণটা সাংস্কৃতিক।

নাগরিক কমিটি ঘোষিত ৮ দফার শেষ দফায় বলা হয়েছে— গণপরিষদ গঠন করে গণভোটের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরির জন্য গণআলোচনার আয়োজন করা।

এই লক্ষ্যে তারা একটা সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করবেন বলেই মনে হয়। যার প্রমাণ জেলা-উপজেলায় তাদের শাখা বানানোর ঘোষণা। তো প্রশ্ন এখন, এই কমিটি কি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারের মতো দেশের আপামর জনতার সমর্থন পাবে? আরও বড় প্রশ্ন, তাদের প্ল্যাটফর্মে কি সাধারণ মানুষ (ডান-বাম-অতিবাম) কি আসবে? কঠিন… খুব কঠিন।

কারণ, আমরা কমিটিতে যে ৫৫ জনকে দেখছি, তাদের প্রায় সবাই জনগণের কাছে নাতিপরিচিত। নাসির-আখতাররা এখনও এমন কোনো ফিগার নন যে জনগণ তাদের পতাকাতলে আসবে। যতদূর বুঝতে পারি, একটা তাত্বিক লক্ষ্যে আনকোরা তরুণদের নিয়ে এই কমিটি করা হয়েছে। এদের অনেকে রাজনীতি করেছেন, কারও আবার সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। অনলাইন দুনিয়ায় আবার কারও পরিচিতি রয়েছে। তবে বলা যায়, সংবাদ পাঠক ও আইনজীবী মানজুর আল মতিন ও কনটেন্ট ক্রিয়েটার সালমান মোক্তাদির ছাড়া অন্যরা বহুল পরিচিত নন। এতে সুবিধা, অসুবিধা দুইটিই আছে।

সুবিধা হলো— জনগণের কাছে কেউ প্রি-ডিটারমাইন্ড ফিগার নন। তাতে কেউ চট করে বলতে পারবে না, আরে ও তো ভেতরে ভেতরে চেতনাধারী বা টুপি অনুসারী ইত্যাদি ইত্যাদি (সত্যি কি তাই?)।

কিন্তু সমস্যা হলো— যেকোনো কমিটি বা সংস্কৃতির পাশাপাশি চাপ সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক শক্তির একটা ‘মুখ’ লাগে। যেমন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সময় জাহানারা ইমাম ছিলেন। এমনটা এই কমিটিতে নেই। তারা মুগ্ধর মাকে সামনে রেখে এগুতে পারতেন। কিন্তু এরা তা করছেন না। হয়তো নিজেদের আলাদা করার চেষ্টা। তারা হয়তো দুর্বল চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী নয়, সক্রিয় হতে চায়, যাদের বুনিয়াদি রাজনৈতিক অভিপ্সা আছে সেটি জানান দিতেই এই ফরম্যাট।

তারপরেও মনে হয় ‘মুখ’ কোথায়? অধিক পরিচিত কাউকে না রাখার আরেকটি কারণ হতে পারে— বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা যখন দল গঠন করবে (সময় বলে দেবে) তখন যেন তাত্ত্বিকদের সাথে রাজনীতিবিদদের কোনো দ্বন্দ না হয়, তা নিশ্চিত করা। নিঃসন্দেহে ইতোমধ্যে কয়েকজন ছাত্র নেতা দাঁড়িয়ে গেছেন। এদের কয়েকজন অন্তর্বর্তী সরকারে যুক্ত হয়েছেন। দল গঠন হলে আমরা হয়তো সেই মুখগুলোকে-ও দেখবো। কিন্তু রাজনীতিতে জাতীয় নাগরিক কমিটির মাঠ তৈরির ওপর সেটা নির্ভর করবে। বেশ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বিষয়টি আবার দীর্ঘ হলেও সমস্যা। দল করতে তত্ত্ব যেমন লাগে, তেমন মাঠে সাংগঠনিক দখলও থাকা জরুরি।

আমার মত, ছাত্ররা যদি দল গঠন করতে চায়, তবে তাদের তৃণমূলে যেতে হবে। একটা সহজ পথ হতে পারে ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচনে অংশ নেয়া। সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা অনেকাংশে ভেঙে পড়েছে। দেশের ইউনিয়ন পরিষদের এক-তৃতীয়াংশও যদি ছাত্ররা ‘দখলে’ নিতে পারে তবে তারা একটা বিরাট জনভিত্তি পাবে। চলমান গণজোয়ার ও দিনবদলের বৈতরনীতে হয়তো সম্ভবও ইউনিয়ন পরিষদে তাদের প্রতিনিধি নিশ্চিত করা। এতে তৃণমূল থেকে জনগণকে ‘তৈরি’ করে ক্ষমতার কাঠামোকে সংশোধন করতে করতে একটা দল গড়ে উঠতে পারে। তখন আর মুখের অভাব হবে না। হাসিনা-খালেদা, তারেক-জয় এমন একটা নিউক্লিয়াসকে ঘিরে রাজনৈতিক দলের চেহারা তৈরির যে সিলসিলা তাও নতুন করে সংজ্ঞায়িত হতে পারে।

আমরা কি তেমনটা দেখবো? এটা নির্ভর করবে ছাত্রদের সততা ও দিনবদলের বাসনা কতটা দৃঢ় তার ওপর। তারা একে অন্যকে কতটা সহ্য করবে, অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে, কতটা আস্থায় রাখতে পারবে— এসবের ওপর। সর্বোপরী একটি গণতান্ত্রিক দল গঠনের যে অভিপ্সা, নতুন বয়ান, তা কার্যকরে যে উদ্ভাবনী পন্থা ও দমের ওপর। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বোঝাপোড়া প্রয়োজন। খুবই কঠিন কাজ । কিন্তু আমি সম্ভাবনা দেখছি…।

লেখক: জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক, যমুনা টেলিভিশন


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply