ভারতের দুনিয়া সমাদৃত শিল্পপতিদের একজন ছিলেন রতন টাটা। তিনি দেশটির অন্যতম বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান টাটা গ্রুপের ইমেরিটাস চেয়ারম্যান ছিলেন। মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
ভারতের গণ্ডি ছাপিয়ে বিশ্ববাণিজ্যের আইকনিক এক নাম রতন টাটা। দেড়শ’ বছরের পুরোনো টাটা গ্রুপকে যিনি নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। শত শত কোটি ডলারের মালিক একজন ভারতীয় কীভাবে হয়ে গেলেন বিশ্ববিখ্যাত শিল্পপতি, আজ শোনা যাক সেই গল্প।
টাটা শিল্পগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জামশেদজি টাটা। ভারতের শিল্পের পথপ্রদর্শক বলা হয় তাকে। বর্তমানে ইস্পাত থেকে শুরু করে সফটওয়্যার, উড়োজাহাজ থেকে লবণের মতো খাতে তাদের ব্যবসা রয়েছে।
১৯৩৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর ভারতের মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন রতন নাভাল টাটা। তার বাবার নাম নেভাল টাটা, যিনি ছিলেন জামসেদজি টাটার দত্তক নেয়া নাতি। মায়ের নাম সুনি টাটা। টাটার উচ্চশিক্ষিত পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশ আমলে ইরান থেকে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
১৯৪০ সালে রতন টাটা হয়ে পড়েন ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি বয়’। তার মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়। ঠাকুমা লেডি নাভাজ বাইয়ের কাছেই বড় হন রতন টাটা। মা-বাবার বিচ্ছেদের কারণে তার শৈশব খুব একটা ভালো কাটেনি।
টাটা কোম্পানির ওয়েবসাইটে উল্লেখ আছে, রতন টাটা মুম্বাইয়ের ক্যাম্পিয়ন ও ক্যাথেড্রাল অ্যান্ড জন কনন স্কুলে পাঠ নিয়েছেন। পাঠশালায় তার লাজুক স্বভাব মানুষের নজরে আসে। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেতেন টাটা।
মুম্বাইতে পড়াশোনা শেষ করার পর রতন টাটা কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে আর্কিটেকচারে ও হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করেন।
স্কুল-কলেজ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন রতন টাটা। সাত বছর যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় গাড়ি ও উড়োজাহাজ চালানো শেখেন এই অকৃতদার। দেশটি তার ভালো লেগে যায়।
কিন্তু বিধিবাম! সেখানে স্থায়ী হতে পারেননি। অসুস্থ ঠাকুমা লেডি নাভাজ বাইয়ের ডাকে তাকে ফিরতে হয় নিজ দেশে। ১৯৬২ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। এই সময়ে জে আর ডি টাটা (যাকে তিনি গুরু মানতেন) তাকে টাটা শিল্পগোষ্ঠীতে যোগ দিতে বলেন। তিনি যুক্ত হন।
টাটা শিল্পগোষ্ঠীতে যোগদানের পর হাতে-কলমে কাজ শেখার জন্য রতন টাটাকে ঝাড়খন্ডের জামশেদপুরে ইস্পাতের কারখানায় পাঠানো হয়। তিনি সেখানে কয়েক বছর কাজ শেখেন। পরে ব্যবস্থাপকের প্রযুক্তিবিষয়ক সহকারীর দায়িত্ব পান। সত্তরের দশকের শুরুতে তিনি টাটার রেডিও, টেলিভিশন ও অন্যান্য টেক্সটাইলেরও দায়িত্ব পান।
পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে টাটা গ্রুপকে নেতৃত্ব দেন জে আর ডি টাটা। ১৯৯১ সালে তিনি রতন টাটাকে নিজের উত্তরসূরি হিসেবে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেন। সে সময়ে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে অনেকেই এই আসনে আসীন হতে পারতেন। তাদের বাদ দিয়ে রতন টাটাকে কেন উত্তরসূরি করা হলো, সেটা নিয়ে তখন বেশ সমালোচনাও শুনতে হয়েছিল তাকে। তবে জে আর ডি টাটার সিদ্ধান্ত যে যথার্থ ছিল, রতন তা প্রমাণ করেন নিজের কাজ দিয়ে।
রতন টাটা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে টাটা গ্রুপ সফলতার শীর্ষে পৌঁছায়। তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটি ইস্পাত প্রস্তুতকারী কোম্পানি ‘কোরাস’ ও বিখ্যাত গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানি জাগুয়ার ও ল্যান্ড রোভারের অধিগ্রহণ করে। এ দুটি সিদ্ধান্তের জন্য প্রশংসার বৃষ্টিতে ভাসেন তিনি।
২০০০ সালে আরও সাফল্যের মুখ দেখে টাটা গ্রুপ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা কোম্পানি ‘টেটলি’ নিয়ে আসে টাটা। তবে সফলতার সঙ্গে ব্যর্থতাও কম ছিল না। টেলিকম খাত ব্যর্থ হওয়ায় টাটা গ্রুপ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে।
২০০৯ সালে রতন টাটার কম দামে ‘ন্যানো’ গাড়ি প্রস্তুত করার প্রকল্পটিও ব্যর্থ হয়। এক সাক্ষাৎকারে টাটা বলেছিলেন, এক লাখ রুপিতে মধ্যবিত্তের হাতে গাড়ি তুলে দেয়ার এই সিদ্ধান্ত নিজের জীবনের অন্যতম বড় ভুল।
টাটা মোটরস, টাটা স্টিল, টাটা পাওয়ার, ন্যাশনাল রেডিও অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্সসহ বহু কোম্পানিকে রতন টাটা নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। ভারতের প্রথম নকশা করা এবং নিজস্ব উৎপাদিত গাড়ি তৈরি করে টাটা মোটরস।
রতন টাটার নেতৃত্বে বিশ্ব বাণিজ্যেও ভারতের অন্যতম নাম হয়ে ওঠে টাটা গ্রুপ। বিভিন্ন দেশে তার শতাধিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে সাড়ে তিন লাখের বেশি কর্মী।
সাড়ে ৫শ’ বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়ে তিনি হয় উঠলেন বিশ্ববাণিজ্যের আইকন। তবু সাধাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন রতন টাটা। বারবার আলোচনায় এসেছেন সমাজকল্যাণমূলক কাজের জন্য। আয়ের দিক থেকে টাটা গ্রুপ শীর্ষে থাকলেও শীর্ষ ধনীদের তালিকায় বরাবরই অনুপস্থিত ছিল তার নাম। কারণ, টাটা গ্রুপের আয়ের বড় অংশই চলে যায় সেবামূলক কাজে।
কেবল ব্যবসায়ী হিসেবেই নয়, সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যাপক আলোচিত ছিলেন তিনি। তার কোম্পানির দুই তৃতীয়াংশ শেয়ারের মালিক বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক ট্রাস্ট। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে রেখেছেন বিশেষ অবদান।
প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে ক্যানসার আক্রান্ত মায়ের মৃত্যুর ঘটনা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল তার ওপর। সেই আবেগ থেকেই তৈরি করেন টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতাল। যা ক্যানসার চিকিৎসায় পুরো উপমহাদেশেই ভরসার এক নাম।
বাণিজ্য ও সমাজসেবায় অবদানের জন্য রতন টাটাকে ২০০০ সালে পদ্মভূষণ এবং ২০০৮ সালে পদ্ম বিভূষণ উপাধিতে সম্মানিত করে ভারত সরকার।
/এএম
Leave a reply