টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। মূলত দর্শককে বিনোদন দিতে এবং ক্রিকেটকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলতে এই ফরম্যাটের উত্থান হয়। বিশ ওভারের জনপ্রিয়তা দেখে ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলো টুর্নামেন্ট আয়োজনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে বাকি দেশগুলোও বিশ ওভারের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারই ধারায় একটা টুর্নামেন্ট আয়োজন করার পরিকল্পনা করতে থাকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি)।
যে পরিকল্পনার বাস্তবায়নই আজকের বিপিএল। ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো মাঠ গড়ায় এই আসর। যেখানে ৬টি দল অংশ নেয়। সেখান থেকে আজ ১০টি বসন্ত পেরিয়ে আগামী ডিসেম্বরে বিপিএলের ১১তম আসর শুরু হতে যাচ্ছে। এবার আসা যাক বিপিএলের আয়-ব্যয়ের হালখাতার হিসেব।
বিপিএলের প্রথম আসরে আয় হয়েছিল ৩৩,০৫,১৩,০০০ টাকা, যেখানে ব্যয় হয়েছিল মাত্র ২১, ৪২,২০৩ টাকা। ফলে বিপিএলের প্রথম আসর থেকে লাভ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড লাভ করেছিল ৩২,৮৩,৭০,৭৯৭ টাকা। বিপুল পরিমাণে আয়ের উৎস হিসেবে গেম অন স্পোর্টসের ভূমিকাই বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেননা বিপিএল শুরুর আগে বিসিবির সঙ্গে গেম অন স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টের ৬ বছরের চুক্তি হয়েছিল।
বিপিএলের দ্বিতীয় আসরে আয় হয়েছিল ৩৮,৭৬,৪০,০০০ টাকা, যেখানে খরচ হয়েছিল ৫,০৯, ৮২,৮৫১ টাকা। ফলে বিপিএলের দ্বিতীয় আসর থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড লাভ করেছিল ৩৩,৬৬,৫৭,১৪৯ টাকা। ফলে বিপিএলের প্রথম দুই আসর থেকে গেম অন স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট বিসিবিকে ৬৬,৫০,২৭,৯৪৬ টাকা প্রফিট দেয়।
২০১৩-১৪ সালে বিপিএল মাঠে গড়ায়নি। ফলে আয়ও করতে পারেনি বিসিবি। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে ২০১৩-১৪ সালে বিপিএল মাঠে না গড়ালেও ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৩,৫৭,৭৯,৩৯৯ টাকা। কারণ হিসেবে জানা যায়, আগের আসরে স্পট ফিক্সিং হয়েছিল। আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ও নিরাপত্তা ইউনিট আকসুর তদন্ত রিপোর্টে ধরা পরে ঢাকা গ্লাডিয়েটর্স। যেখানে আকসুর নির্দেশনা অনুযায়ী বিসিবির একটি ট্রাইব্যুনাল কোর্ট করতে হয়েছিল। এই ট্রাইব্যুনালে যারা ছিলেন তাদের পেছনে বিসিবিকে বিপুল পরিমাণে টাকা খরচ হয়েছিল।
শাকিল কাসেম নামে এক প্রকটন ক্রিকেটারও এই ট্রাইব্যুনালে ছিলেন। সে সবচেয়ে কম পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন, তবে সে যে পারিশ্রমিক নিয়েছিলে সেটিও চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। পারিশ্রমিক হিসেবে ৫৪ লক্ষ তাকা নিয়েছিলেন তিনি। বিসিবিকে শুধু মাত্র কোর্ট পরিচালনা করতেই এই বিপুল পরিমাণে টাকা ব্যয় করতে হয়েছিল। এখানেই শেষ নয়, পরবর্তী বছরেও ৭৫,২৭,৭১৫ টাকা খরচ করতে হয়েছিল এই ট্রাইব্যুনাল কোর্ট চালাতে।
স্পট ফিক্সিং কাণ্ডের কারণে দুই বছর বিরতির পর ২০১৫-১৬ সালে ফের মাঠে গড়ায় বিপিএল। এটি বিপিএলের তৃতীয় আসর ছিল যেখানে আয় হয়েছিল ৪১,৫৯,৩২,০০০ টাকা যেখানে খরচ হয়েছিল ১৫,০০, ৪৭,৭০৯ টাকা। তাতে বিপিএলের তৃতীয় আসর থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড লাভ করেছিল ২৬,৫৮,৮৪,২৯১ টাকা। এছাড়াও, বিপিএলের ৪র্থ আসরে আয় হয়েছিল ৪৪,৩৪,৮১,০০০ টাকা যেখানে খরচ হয়েছিল ১৩,৩৮,৩০,৯০১ টাকা।
বিপিএলের ৩য় আসর থেকেই ব্যয়ের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, ২০১৫-১৬ সাল থেকে বিপিএলের সমস্ত কিছু বিসিবি নিয়ন্ত্রণ করে। গেম অন স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট যেখানে খবরচ করেছিল মাত্র ২১ লাখ টাকা সেখানে তাদের সাথে চুক্তি বিচ্ছিন্ন করেছে। বিপিএলের তৃতীয় আসর থেকেই গেম অন স্পোর্টসের সাথে সম্পর্ক চ্যুত করে বিসিবি। শুধু তাই নয় ফ্র্যাঞ্চাইজিদের সাথে ৬ বছরের চুক্তি থাকলেও সেই চুক্তিও শেষ হয়ে যায়। তখন থেকে বিসিবি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিপিএল পরিচালনা শুরু করে এবং তখন থেকেই ব্যয়ের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে।
বিপিএলের পঞ্চম আসরে আয় হয়েছিল ৪৫,৭৩,১৬,৬৭৩ টাকা যেখানে খরচ হয়েছিল ৩৭,৫৭, ৪১,২৪০ টাকা। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যায় বিসিবি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিপিএল পরিচালনা করার পর থেকে ব্যয়ের পরিমাণ কীভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। এবার আসা যাক বিপিএলের ষষ্ঠ আসরের হালখাতা। বিপিএলের ৬ষ্ঠ আসরে আয় হয়েছিল ৯৭,১৯,৬০,৩১৬ টাকা যেখানে খরচ হয়েছিল ৮৩,৩৬,৭৯,৬১২ টাকা। যা বিপিএল ইতিহাসের সর্বোচ্চ ব্যয়। শুধু বিপিএল ইতিহাসেই নয়, বাংলাদেশে যতগুলো আইসিসি ইভেন্ট হয়েছিল তার থেকেও বেশি ব্যয় হয়েছিল বিপিএলের ৬ষ্ঠ আসরে।
২০১১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কো-হোস্ট এবং ২০১৪ সালে আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পুরুষ ও নারীদের আয়োজক ছিল। যেখানে ১৬টি পুরুষ ও ৮টি নারী দল অংশগ্রহণ করে। উদ্ভূত ব্যাপার হলো- ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বিসিবির খরচ হয়েছিল ৪১ কোটি টাকা। এর বিপিএলে ৭টি দলের পেছনে খরচ হয়েছে ৮৩,৩৬,৭৯,৬১২ টাকা। মূলত এই যায়গায় প্রশ্ন থেকে যায়, কেন এতো টাকা ব্যয় হলো?
আরেকটি বিষয়ে জানা যাক, বিপিএলের ৬ষ্ঠ আসরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খরচ হয়েছিল রেকর্ড প্রায় ১৬ কোটি টাকা। উদ্বোধনী ওই অনুষ্ঠানে বলিউডের সুপারস্টার সালমান খান এবং জনপ্রিয় নায়িকা ক্যাটরিনা কাইফ পারফর্ম করেছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ২০১১ সালে গালা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খরচ হয়েছিল সাড়ে ১১ কোটি টাকা। যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল বাংলাদেশ। আইএমজি রেটিং অনুযায়ী বেইজিং অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরের স্থানে রয়েছে এটি।
২০২০-২১ সালে করোনার কারণে বিপিএল মাঠে গড়ায়নি। তবে বিশেষ কারণে আয় ছিল ২,৫৬,১৮,৯৩৬ টাকা এবং লজিস্টিক্যাল খরচ হিসেবে ব্যয় হয় ৩৮,০৫,৯২১ টাকা। ২০২১-২২ সালে ফের মাঠে গড়ায় বিপিএল। এটি ছিল বিপিএলের ৭ম আসর। যেখানে আয়ের পরিমাণ ছিল ৩৮,৫৮,৭১,৪৭৬ টাকা আর ব্যয় হয়েছিল ১৯,১২,৭২,২৫১ টাকা।
বিপিএলের ৮ম আসরে আয় হয়েছিল ৫৩,০৬,৬১,০৩৪ টাকা যেখানে খরচ হয়েছিল ৩৫,৭০, ৮৮,৯২৮ টাকা। বিবিপেলের ৯ম আসরে আয়ের পরিমাণ ছিল ৫৬,৪৮,০০,০০০ টাকা যেখানে খরচ হয়েছিল ৫১,৫৬,৮০,০০০ টাকা। যেখানে দেখা যায় লাভের পরিমাণ মাত্র ৫ কোটি টাকা। সময়ের গড়ানোর সাথে সাথে লাভের পরিমানও কমতে থাকে।
এবার আসা যাক বিপিএল হালখাতার মোট হিসেবে। বিপিএলের ১০টি আসর মিলিয়ে বিসিবির মোট আয় ৪৯৭,৩৮,০০,৫৫২ টাকা আর ব্যয় হয়েছে ২৭৮,০৯,৯১,০২৮ টাকা। ফলে বিপিএলের সব আসর মিলিয়ে বিসিবির লাভ হয়েছে ২১৯,২৮,০৯,৫২৪ টাকা। সেক্ষেত্রে বিপিএল থেকে লাভের ২১৯,২৮,০৯,৫২৪ টাকা বিসিবির ফান্ডে থাকার কথা। জানা যায়, এই ২১৯ কোটি টাকার মধ্যে বিসিবির একটি এফডিআর আছে। সেই এফডিআরে তাকার পরিমাণ আছে ৮৭ কোটি টাকা। মজার ব্যপার হচ্ছে বিসিবি সর্বোষেষ যে ব্যালেন্সের হিসেব দিয়েছে সেখানে বিপিএলের ক্লোজিং ব্যালেন্স ছিল ১১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০৬ কোটি টাকার হিসেব মিলাতে পারছে না বিসিবি। পরিশেষে বলা যায়, আয়-ব্যয় মিলিয়ে ১০৬ কোটি টাকার হদিস নেই।
/আরআইএম
Leave a reply