মেহেদী হাসান রোমান⚫
আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে চলছে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক একটি সম্মেলন। যা সংক্ষেপে পরিচিত কপ সম্মেলন নামে। বৈশ্বিক এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রপ্রধান। এই সম্মেলনের সাথে অন্যান্য অঞ্চলগত সম্মেলনের বেশ পার্থক্য রয়েছে।
যেমন, সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ হলেই কমনওয়েলথ সম্মেলনে কোনো দেশ অংশ নেয়। আবার দক্ষিণ এশিয়ার সার্ক-বিমসটেক অথবা আসিয়ানের পাশাপাশি জি-৮ বা ডি-৮ সম্মেলনে অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসের আলোকে সদস্যপদ বিবেচিত হয়। আফ্রিকার একটি গরিব দেশ নিশ্চয়ই শিল্পোন্নত দেশের সংগঠন জি-৮ এর সদস্য হবে না।
কিন্তু কপ সম্মেলনের বিশেষত্বটা কোথায়? এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে অর্থনীতি কিংবা সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের নয় বরং পৃথিবীর পরিবেশগত বিষয়ের আলোচনার মিলনমেলা।
গত শতাব্দীর সবশেষ দশকে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে পরিবেশবিষয়ক একটি জলবায়ু সম্মেলন হয়। সেখানে বিশ্বের নেতারা প্রথমবারের মতো পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে বড় পরিসরে ভাবার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুখী-সুন্দর একটি পৃথিবী বিনির্মাণের ঘোষণা দেন।
১৯৯৫ সালে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে বসে বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন। এরপর থেকেই প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে এটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
চলতি বছর বাকু সম্মেলনে দেখা যায়নি একাধিক শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের। সম্মেলনে আসেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী কিংবা পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রীও অংশ নেননি সেখানে। ভারতের প্রতিনিধি হয়ে সম্মেলনে গেছেন দেশটির পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী কীর্তিবর্ধন সিং।
ভারতে এমনিতে প্রতিমন্ত্রীদের খুব একটা গুরুত্ব নেই বলে শোনা যায়। দেশটির সাবেক কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী তার দায়িত্বে থাকার সময় বলতেন, প্রতিমন্ত্রীরা হলেন অর্ধেক-মন্ত্রী। ফলে একজন প্রতিমন্ত্রী কপ ২৯-এ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করায় প্রশ্ন উঠেছে, এই সম্মেলনকে কি গুরুত্ব দিচ্ছে না ভারত? দিলেও কতটুকু? অথচ দিল্লির বাতাস নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ার পাতায় প্রায়ই অশনি সঙ্কেত দেখতে পাওয়া যায়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগামী ১৬ থেকে ২১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী মোদি বিদেশ সফর করবেন। তিনি নাইজেরিয়া, ব্রাজিল ও গায়ানা যাবেন। কাকতালীয় হলেও ঘটনা হলো, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভাও কপ ২৯ সম্মেলনে আসেননি। হতে পারে আন্তর্জাতিক এই সম্মেলন থেকেও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসকেও দেখা যায়নি এবারের সম্মেলনে।
অবশ্য এসব বিশ্বনেতাদের সম্মেলনে না আসার একাধিক কারণও রয়েছে। যেগুলো তাদের স্ব স্ব দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। ভারতের একাধিক রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের ডামাডোল চলছে। জার্মানিতে রাজনৈতিক সঙ্কট বেড়েছে, দেশটিতে আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের দল গেল সপ্তাহে ভোটে হেরেছে। হোয়াইট হাউসের প্রস্থান ঘটার দামামা বাজতে না বাজতেই তিনি পরিবেশ নিয়ে ভাবতে যাবেনই বা কেনো?
কপ সম্মেলনের একাধিক ইতিবাচক ঘটনা রয়েছে যা বৈশ্বিক পরিবেশগত উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যেমন, ১৯৯৭ সালে টোকিতে কপ-৩ সম্মেলনে গৃহীত হওয়া ‘কিয়েটো প্রটোকল’ নামের একটি চুক্তি আলোচনায় আসে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ানো রোধ করতে এবং গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমানোর জন্য এই চুক্তিটির খসড়া ওই সম্মেলনে হলেও, এর কার্যকারিতা শুরু হয় ২০০৫ সালে।
চুক্তির খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী, উন্নত দেশগুলোর ২০১২ সালের মধ্যে গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ ৫ দশমিক ২ শতাংশ কমানোর কথা ছিল। তবে নির্দিষ্ট সময়ে এসে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ হয়নি। এই চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয় আরও আট বছর।
২১তম কপ সম্মেলনে ‘প্যারিস চুক্তি’ নামের একটি নতুন চুক্তি হয়। যেখানে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট মোকাবেলায় দ্রুত কাজ করতে হবে এবং কার্বন নিঃসরণ কমাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। চুক্তির লক্ষ্য ছিল, এই শতাব্দীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের (প্রি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরা) তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি না হওয়া। এছাড়া, আগের চুক্তি (কিয়েটো প্রটোকল) যা অর্জন করতে পারেনি, তা প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন করে অর্জন করা সম্ভব বলেও আশা করা হয়। তাই, পরিবেশগত উন্নয়নের সাথে আগের কিছুর খামতি থাকলে সেটির সম্পূরক প্রস্তাবনাও দেয়া হয় সেবারের কপ থেকে।
জলবায়ু পরিবর্তন এখন দৃশ্যমান একটি সঙ্কট। বাটারফ্লাই ইফেক্টের ফলে যেমন পৃথিবীর একপ্রান্তের ঘটনার রেশ অপরপ্রান্তে বর্তায়, তেমনি অ্যান্টার্কটিকায় একটু একটু করে বেশি বরফ গলার ফলে মালদ্বীপের ভূ-পৃষ্ট কবে নাগাদ পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যাবে, তা নিয়ে রয়েছে দুশ্চিন্তা।
বিশ্বায়ন আর প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে বিশ্ব মেতে আছে যুদ্ধ-অস্ত্র আর ক্ষমতার মহড়া দেখানোর বিশাল এক আয়োজন নিয়ে। আদতে ছোট্ট আয়তনের নিম্ন অর্থনীতির স্কেলের দেশ উত্তর কোরিয়াও পরমাণু শক্তির প্রেক্ষাপটে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে চায়। বৈশ্বিক মোড়ল দেশগগুলো তো আরও এগিয়ে। কেউ নিজেরা যুদ্ধ করছে সরাসরি, কেউ আবার পেছন থেকে কলকাঠী নেড়ে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। অথচ পরিবেশ বিষয়ক একটি সম্মেলনে গেল কয়েক বছর ধরেই উদাসীনতা দেখা যায় সেসব গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বনেতাদের। কেউ বিকল্প কাউকে পাঠায়, কেউ বা প্রতিনিধিই পাঠায় না।
সম্প্রতি, পরিবেশ বিজ্ঞানী বিল হেয়ার বার্তাসংস্থা এপি’কে বলেছেন, পরিবেশ নিয়ে সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাব দেখা যাচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার তাগিদটাই নেই। এই যে তাগিদটা শক্তিশালী কিছু দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নেই, এই না থাকাটা দৃশ্যমান।
কিন্তু এই ইচ্ছাশক্তি বাড়ানো যায় কীভাবে? কোথায় মিলবে এর টনিক? উত্তর হয়ত পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। তবে কি এই কপ ধীরে ধীরে হয়ে যাবে খর্বাকৃতি শক্তির দেশগুলোর মিলনমেলা? আর তা-ই যদি হয়, তবে এর দায়ও কি বিশ্ব মোড়লদের ওপরই বর্তায় না?
/এমএইচআর
Leave a reply