প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ রূপে সজ্জিত উঁচু নিচু সবুজে ঢাকা দেশের সর্বোচ্চ পাহাড় কেওক্রাডং, তাজিংডংসহ জেলার উন্মত্ত জলপ্রপাত। সেই সঙ্গে আছে জেলায় বসবাসরত ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী, বাঙ্গালিসহ ১২টি সম্প্রদায়ের মানুষ। এসব কারণে প্রতিবছর সারাদেশের হাজার হাজার পর্যটক ভ্রমণ করেন জেলাটিতে। বলছিলাম, বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্পট বান্দরবানের কথা। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৭৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জেলাটি। যেখানে পাহাড়, নদী, ঝর্ণা ও নানা ঐতিহ্যবাহী স্থান একসঙ্গে উপভোগ করা যায়।
সম্প্রতি পর্যটকদের জন্য বান্দরবান ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আসে। এক মাস পর সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। এতে প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে বান্দরবানের চার উপজেলায়। এবার পর্যটকদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ যোগ হয়েছে চিম্বুক-নীলগিরি ও মেঘলা-নীলাচলে চলাচলের জন্য ছাদখোলা বাস। এ তথ্য শুনে আপনার মন কি আঁকুপাঁকু করছে বান্দরবান যেতে? তাহলে চলুন, জেনে নেয়া যাক বান্দরবানের ১০ দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে।
নীলাচল, বান্দরবান সদর
বান্দরবান সদর উপজেলার একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থান নীলাচল। প্রধান শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে টাইগারপাড়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০০ ফুট উপরে অবস্থিত। যেখানে বাইরের দিকটা ছিন্নভিন্ন পাহাড়ে সাজানো হলেও ভেতরটা অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ। এখানে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ি রাস্তা, ছোট পাহাড়ি পাড়া, আর রূপালি নদী যেন শিল্পীর আঁকা ছবি। শহর থেকে চট্টগ্রামের পথে তিন কিলোমিটার হাঁটার পর বাঁদিকের ছোট রাস্তা ধরে নীলাচলে পৌঁছানো যায়। এখানে দুই কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে আপনি উপভোগ করতে পারবেন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মনোরম দৃশ্য। নীলাচল একটি নির্জন শান্তির স্থান, যেখানে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিয়েছে।
নীলগিরি, থানচি
নীলগিরি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম উঁচু শৃঙ্গ। পুরো এলাকা মেঘে ঢাকা থাকায় দর্শনার্থীরা নীলগিরিকে ‘মেঘের দেশ’ বলে অভিহিত করেন। নীলগিরির সূর্যোদয়ের দৃশ্যটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক এবং কুয়াশাচ্ছন্ন শীতকালে এটি যেকোনো পর্যটককে মুগ্ধ করতে পারে। মনোরম হেলিপ্যাডটি নীলগিরির সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর একটি।
চিম্বুক পাহাড়, থানচি
চিম্বুক পাহাড় বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম পর্বত। বান্দরবান জেলা থেকে এটি প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এর সুউচ্চ শিখর থেকে বিস্তৃত এলাকা দেখলে মনে হবে– আপনি মেঘের মধ্যে ডুব দিয়েছেন। দর্শনার্থীরা সাধারণত চিম্বুক, নীলগিরি, মিলনছড়ি ও শৈলপ্রপাত ঝর্ণা একসঙ্গে ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন। তবে মনে রাখতে হবে, বিকেল ৪টার পর এই রুটে কোনো যানবাহন চলাচল করে না। তাই সময়মতো যাত্রা শুরু করা জরুরি।
শৈলপ্রপাত ঝর্ণা, থানচি
মিলনছড়ির জলপ্রপাতটি থানচি থানা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত। এর স্বচ্ছ ও ঠান্ডা পানি স্থানীয়দের জন্য বিশুদ্ধ জলের বড় উৎস। ঝর্ণার আশেপাশে স্থানীয় বাজারও রয়েছে, যেখানে পর্যটকরা স্থানীয় পণ্য ও খাবারের স্বাদ নিতে পারেন। শৈলপ্রপাত, নীলগিরি ভ্রমণের পথে ঝর্ণাটি দেখে নেয়া যায়।
বগালেক, রুমা
বগালেক তার বিস্ময়কর নীল পানির জন্য বিখ্যাত। বর্ষাকালে রাস্তাগুলোর অবস্থা খারাপ থাকায় বগালেকে পৌঁছানো কিছুটা কঠিন হয়ে পড়ে তবে শীতকালে এটি একটি দারুণ ভ্রমণস্থল। বগালেক পৌঁছানোর জন্য রুমা বাজার থেকে ১৭ কিলোমিটার হাঁটা পথ পার করতে হয়, তবে সেই পথের সৌন্দর্যও কিছু কম নয়। শীতকালে ক্যাম্প ফায়ারের অভিজ্ঞতাও এখানে অনন্য।
স্বর্ণ মন্দির, বান্দরবান সদর
বান্দরবানে অবস্থিত বুদ্ধ ধাতু জাদি মন্দির বা স্বর্ণ মন্দিরটি দেশের অন্যতম প্রধান বৌদ্ধ মন্দির। মায়ানমারের কারিগরদের তৈরি কাঠের এই মন্দিরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধমূর্তি রয়েছে। মন্দিরটি প্রায় ৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এবং এখানে ভ্রমণ করতে হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যেতে হয় (সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ১১টা এবং দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা)। প্রবেশ ফি ২০ টাকা, যা দিয়ে আপনি এখানকার স্থাপত্য ও প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।
তিন্দু, থানচি
তিন্দু বা ‘বাংলাদেশের নায়াগ্রা’ পানির ধারা এবং প্রকৃতির মেলবন্ধনকে এক নতুন মাত্রা দেয়। এই এলাকা সাঙ্গু নদী, পাহাড়, মেঘ, জলপ্রপাত আর রহস্যময় পরিবেশে ঘেরা; যা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ভ্রমণকারীদের কাছে আকর্ষণীয়। বান্দরবান থেকে থানচি যেতে প্রায় ৭৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয় এবং এ পথে মিলনছড়ি, চিম্বুক, নীলগিরির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। থানচি থেকে তিন্দু যেতে সাঙ্গু নদীতে নৌকা ভাড়া করে প্রায় দুই ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়। সাঙ্গু নদীর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এক বিশেষ অভিজ্ঞতা এনে দেয়।
কেওক্রাডং, রুমা
কেওক্রাডং বাংলাদেশের অন্যতম উচ্চতম পর্বত, যার উচ্চতা ৩ হাজার ১৭২ ফুট (৯৬৭ মিটার)। এটি রুমা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং এই এলাকায় পাহাড়, ঝর্ণা ও প্রকৃতির অপূর্ব রূপ রয়েছে। কেওক্রাডং বাংলাদেশের ও মায়ানমারের সীমান্তে অবস্থিত, যার কারণে এটি ভ্রমণকারীদের জন্য বিশেষ আকর্ষণীয়। এখানকার সবুজ পাহাড়, শীতল ঝর্ণা ও আঁকাবাঁকা পথ সত্যিই এক নিখুঁত প্রকৃতির অভিজ্ঞতা দেয়। যাত্রাপথে দার্জিলিং পাড়া নামে একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গ্রাম রয়েছে, যেখানে পর্যটকরা বিশ্রাম নিতে পারেন।
জাদিপাই জলপ্রপাত, রুমা
জাদিপাই জলপ্রপাত কেওক্রাডং পাহাড় থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বান্দরবানের সর্বোচ্চ গ্রাম পাশিংপাড়া পেরিয়ে এই জলপ্রপাতের পথে পৌঁছাতে হয়, যা এক দারুণ অ্যাডভেঞ্চার। এই পথ বর্ষায় কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও শুষ্ক মৌসুমে এটি সহজে পৌঁছানো যায়। পাশিংপাড়া থেকে ৪০ মিনিট হাঁটার পর জাদিপাই ঝর্ণার কাছে পৌঁছানো যায়। বর্ষায় ঝর্ণার পানিপ্রবাহ আরও ভিন্ন এক রূপ ধারণ করে, যা ভ্রমণকারীদের জন্য বিশেষ অভিজ্ঞতা তৈরি করে। এখানকার শান্ত পরিবেশ ও সবুজ প্রকৃতি বিশেষ দর্শনীয়।
নাফাখুম, রেমাক্রি
নাফাখুম বাংলাদেশের বৃহত্তম জলপ্রপাতগুলোর একটি, যা ‘রেমাক্রি জলপ্রপাত’ নামে পরিচিত। নাফাখুমের বিস্তৃত ও অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে থাকা সম্ভব নয়। এটি বান্দরবানের রেমাক্রি গ্রামে অবস্থিত। প্রায় ৩২৫ ফুট উচ্চতা থেকে জলপ্রপাতটি ঝরে পড়ে, যা ভ্রমণকারীদের কাছে হবে এক দারুণ আকর্ষণ।
যেহেতু চিম্বুক-নীলগিরি ও মেঘলা-নীলাচল পথে পর্যটকদের জন্য চালু করা হচ্ছে ছাদখোলা বাস, তাই এখনই সুযোগ বান্দরবান ঘুরে আসার। এই হেমন্তে অথবা শীতে আপনি বন্ধু বা প্রিয়জন নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন পাহাড়ঘেরা অঞ্চলে। আপনি যদি ‘সলো ট্রাভেলার’ হন, তবে একাই নেমে পড়ুন আর বলুন–
‘পথের বাপই বাপরে মনা, পথের মাই মা
পথের বুকেই খুঁজে পাবি আপন ঠিকানা..’
এসআইএন/এএম
Leave a reply