আল মাহফুজ
‘আই অ্যাম কমিউনিস্ট, আই বিয়ার ইট ইন মাই নেম।’ বাংলার মঞ্চ ও চলচ্চিত্রজগতে কৌতুক ও রসাভিনয়ে যার নাম সবার আগে মাথায় আসে, তিনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পোশাকি নাম ‘সাম্যময়’। নিজের নাম নিয়ে ভানু কেমন রসিকতা করতেন, প্রথম বাক্যটি পড়লেই আপনার বুঝে যাওয়ার কথা। আপনি বুঝে গেছেনও।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম দিকে ‘ভানুসিংহ’ ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। বৈষ্ণব কবিদের অনুকরণে ব্রজবুলি ভাষায় লেখা সেসব পদাবলি ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। পরে (১৮৮৪ সালে) তা মলাটবদ্ধ হয় ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী নামে। বইটির উৎসর্গপত্র থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের বৌঠান কাদম্বরী দেবী তাকে ভানুসিংহের কবিতাগুলো প্রকাশ করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু এই বই প্রকাশের পূর্বেই আত্মহত্যা করেছিলেন কাদম্বরী।
আজ ভানুসিংহ কিংবা কাদম্বরী নিয়ে কোনো আখ্যান করছি না, আজ গল্প থাকছে ভানুর (বন্দ্যোপাধ্যায়) সরস পদাবলির। যিনি নিজেকে ‘ঢাকার ভানু’ হিসেবে পরিচিত করতে ভালোবাসতেন।
উইটি, হিউমার আর কৌতুকের জন্য বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে যিনি পরিচিত, তিনি মূলত ঢাকার সন্তান। ১৯৪১ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে এক পরিচিতজনের গাড়ির পেছনের সিটের পাদানিতে শুয়ে কলকাতায় পাড়ি জমান ভানু। তবে সেখানে তার শরীর পড়ে থাকলেও মন পড়েছিল ঢাকাতে। আর স্মৃতিময় ঢাকার জাবর কাটতে কাটতেই ১৯৮৩ সালের ৪ মার্চ তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
ষাটের দশকে বাংলা সিনেমায় ‘উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন’ জুটির মতো ‘ভানু-জহর রায়’ জুটির দাপটও কম ছিল না। আরেক বিখ্যাত জুটি ‘লরেল ও হার্ডি’র মতো ভানু-জহর কমেডিয়ানদের স্ক্রিনে আলাদা জায়গা করে দিতে বাধ্য করতেন। লরেল ও হার্ডি ব্রিটিশ-আমেরিকান অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি পেলেও ভানু (ঢাকা) ও জহর (বরিশাল) ভারতীয় অভিনেতা হিসেবেই পরিচিত।
ভানু একবার সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনেন। জহর রায় সভা ডেকে সেই গাড়ি কেনার সেলিব্রেট করেন কলাকুশলীদের নিয়ে। ভানুকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘ভানু গাড়ি কিনেছে কমেডির টাকা দিয়ে, এ গাড়ি ওর একার নয়, সকল কমেডিয়ানের। প্রত্যেক শনিবার আমার বাড়ি গাড়ি পাঠিয়ে দিবি।’ ঘটেছিলোও তাই। শনিবার জহর আসতেন গাড়িতে আর ভানু আসতেন ট্রাম বা ট্যাক্সি ধরে। বন্ধুত্বের কী নির্মল দাবি এবং তার প্রতিফলন!

ভানু কমেডিকে ভাঁড়ামি ভাবতেন না। কাতুকুতু দিয়ে মানুষ হাসাতে অপছন্দ করতেন। তার অঙ্গভঙ্গি, বাচনভঙ্গি, নিখুঁত টাইমিংয়ে মোক্ষম সংলাপ ইত্যাদি দেখে হেসে গড়াগড়ি খেতো দর্শক। এক কথায়, ভানু কমেডিকে রূপান্তর করেছিলেন যেন আর্টে।
অসংখ্য সিনেমায় ‘সাম্যময়’ অভিনয় করেছেন। তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। চলচ্চিত্রের কাহিনী, সংলাপ লিখেছেন। বলা হয়, উপমহাদেশে তিনিই প্রথম কমিক রোল প্রতিষ্ঠা করেছেন। পাশাপাশি সিরিয়াস অভিনয়েও ছিল সমান পারঙ্গম।
তার জনপ্রিয় সিনেমার মধ্যে অনেকেই হয়তো ‘সাড়ে চুয়াত্তর‘-এর কথা বলবে। এক অর্থে তা ঠিক। নামকরা অভিনেতারা যখন ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে সংগ্রামরত, তখন ‘ঢাকাইয়া কুট্টি’ একসেন্টের চমকপ্রদ অভিনয় দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ভানু। ঢাকায় যখন ছিলেন, ঘোড়ার গাড়ির চালকদের সঙ্গে মিশতেন। কুট্টিদের তীক্ষ্ণ রসবোধ ‘বিক্রমপুরের পোলা’র কৌতুকপ্রতিভা বিকশিত করতে সাহায্য করেছিল, এটা বলা যায় নির্দ্বিধায়।
‘ওরা থাকে ওধারে‘, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ‘, ‘ভানু পেল লটারি‘, ‘পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট‘ এগুলো তার উল্লেখযোগ্য কাজ। ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ ও ‘স্বর্গ মর্ত্য’-এর মতো দুর্বিনীত ছবি দেখে যারপরনাই অবাক হতে হয়। এখনকার দিনে এমন কনসেপ্টের সিনেমা নির্মিত হয় না বললেই চলে।
পরবর্তীকালে আমরা বয়সী ভানুকে দেখতে পাই। ‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘৮০ তে আসিও না’, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর এ্যাসিস্ট্যান্ট‘ প্রভৃতিতে স্বাক্ষর রাখেন সহজাত অভিনয়ের। তার নামে দু’দুটি সিনেমার টাইটেল হয়, যা তখনকার যুগে ছিল এক বিরল ঘটনা।
১৯৫৯ সালে নির্মল দে পরিচালিত ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে‘ অভিনয় করে ভানু যেন সব আলো কেড়ে নেন। হাস্যরস ও সিরিয়াসনেসের সমন্বয়ে সিনেমাটার গল্প এগোয়। গান যেমন এই ছবির প্রাণ, তেমনি ভানুর পরিণত অভিনয়ও দর্শককে তার প্রতি আরও মনোযোগী করে তোলে। চ্যাপলিনের ‘সিটিলাইটস‘ ও ‘লাইমলাইট‘-এর অনুপ্রেরণা (যার অভিনয়ের অনুপ্রেরণা ছিল খোদ চ্যাপলিনই) আছে ছবিতে, তবে তা এদেশীয় ভঙ্গিতে ও বয়ানে নির্মিত।

কমেডি বা মকারির মাধ্যমে মানুষের চেতন সত্তাকে ধাক্কা দেয়াটাই ভানু প্রধান কর্তব্য মনে করতেন। ‘বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে যা কিছু সমাজের, সাধারণ মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী, আমি দরকারমতো, সাধ্যমতো তার বিরুদ্ধে মানুষকে খোঁচা দিয়ে জাগানোর জন্য নাটক, সিনেমা করে যেতে চাই। তা সে ব্যঙ্গ বা সিরিয়াস, যা কিছু হোক না কেন। এটাই আমার কমিটমেন্টের শেষ কথা।’
লেখাটা শেষ করছি ভানুর একটা চুটকি দিয়ে। ‘আমি বাঙাল হলে আপনি কী? বাঙালি? বিষয়টা ব্যাকরণে ফেলান। আমি পুংলিঙ্গ আর আপনি স্ত্রীলিঙ্গ!’ বাংলাদেশিদের বাঙাল বলে খাটো করা কলকাতার বাবুদের উদ্দেশ করে বলা।
রসের সঙ্গে ব্যঙ্গ মিশিয়ে পরিবেশনায় যিনি পটু ছিলেন, তিনি ভানু। আপাদমস্তক রসবোধের বাড়িতে যার বসবাস, তিনি ভানু। এই গুণী অভিনেতার আজ প্রয়াণ দিবস। তার প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
Leave a reply