পুলিশ সংস্কার: সাউন্ড গ্রেনেড নিষিদ্ধের আবেদন

|

জাহিদ হোসাইন খান

জুলাই বিপ্লবের সময় বিক্ষোভ দমনে হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়েছিল। গুলি ছোড়া ছাড়াও এই গ্রেনেডের বিকট শব্দে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়েছিল। আমি নিজে ১৯ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই কর্মসূত্রে এসব সরাসরি দেখেছি। কাজের প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বের হলে সাউন্ড গ্রেনেড চার্জের মুখে পড়ি কয়েকবার।

সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে পড়েছিলাম রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডের একটি বিক্ষোভের সময়। সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ এখনো কানে ধরে আছে মনে হয়। সেদিনের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আজও আমাকে তাড়া করে। আমি শারীরিকভাবে গুরুতর আহত না হলেও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ তখনও কানে বেজে চলছিল, দিনের পর দিন আমি স্বাভাবিকভাবে শুনতে পারছিলাম না। একজন নাগরিক হিসেবে আমার প্রশ্ন, একটি স্বাধীন দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কীভাবে তাদের জনগণের ওপর এমন ভয়ঙ্কর হাতিয়ার ব্যবহার করতে পারে?

ভয়ের খবর

সেই সময়ের কিছু সংবাদ আমাদের এখনো ভয় দেখায়। আমরা দেখেছি, সিলেটে শিক্ষার্থীদের পদযাত্রায় পুলিশের বাধা, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে ছত্রভঙ্গ (প্রথম আলো, ৩১ জুলাই)। সমকাল (২৫ জুলাই, ২০২৪) বলছে, পুলিশ ছাড়াও ছিল গুলির অন্য উৎস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের কফিন মিছিল, পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ (প্রথম আলো, ১৭ জুলাই)। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ: প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখলেন সাউন্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণ, পুলিশ বলছে ককটেল (প্রথম আলো, ৩০ জুলাই)।

এমন অসংখ্য সংবাদ তখনকার পত্রিকায় চোখে পড়বে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে উন্মুক্ত প্রান্তরে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেডের মাধ্যমে নিজের উপস্থিতি প্রমাণ করার কাজ করেছিল।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহার

আমরা ২০২৩ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে পুলিশকে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করতে দেখেছি। টিভিতে দেখেছি, পত্রিকায় ছবি দেখেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করেছিল, তারা জনসাধারণের ক্ষতি এড়াতে এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

তবে আমরা দেখেছি যে, এই সময়ের মধ্যে বাড্ডা ও নারায়ণগঞ্জসহ অন্যান্য এলাকায় সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহার সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে ব্যবহার করা হয়েছে। অনেকেই অপ্রত্যাশিতভাবে আহত হয়েছেন। এমন আচরণের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থা কমেছে।

সাউন্ড গ্রেনেডের উৎস

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের গণমাধ্যমের একটি প্রতিবেদনে থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেডসহ অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করে। তখন প্রায় ৫২ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়, যার জন্য বাজেট ধার্য করা হয়েছিল প্রায় ২০ লাখ টাকা। এর আগেও ২০১৬ সালে পুলিশ জরুরি ভিত্তিতে ব্রাজিল থেকে সাউন্ড গ্রেনেড আমদানি করেছিল, যা দাঙ্গা ও সহিংসতা দমনের জন্য ব্যবহার করা হয়। ২০০৯ সালে চীন থেকে ৫০ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড আমদানি করারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। জনগণের ট্যাক্সের অর্থ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেখছি আমরা।

শরীর ও মনের ওপরে প্রভাব

সাউন্ড গ্রেনেড, যা সংবাদপত্রে ও গবেষকদের কাছে ফ্ল্যাশবাং নামেও পরিচিত। সাধারণত সামরিক ও পুলিশ বাহিনী এই গ্রেনেড ব্যবহার করে জনসমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য। এই একটি ধ্বংসাত্মক অস্ত্র বেশ উচ্চমাত্রার শব্দ তৈরি করে। প্রায় ১৭০-১৮০ ডেসিবল ভয়ানক শব্দ তৈরি হয়। আর উজ্জ্বল আলোর ঝলক সৃষ্টি করে। এই গ্রেনেডের প্রভাব মানবদেহের ওপর মারাত্মক হতে পারে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সাউন্ড গ্রেনেডের উচ্চমাত্রার শব্দে ক্ষণস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে যে কেউ। শিশুদের ওপর এর প্রভাব বেশি। জুলাই-আগস্টে আমরা দেখেছি, পুলিশ শিশুদের ওপরেও নির্যাতন চালাতে দ্বিধাবোধ করেনি।

গবেষণা অনুযায়ী, ১২০ ডেসিবল বা তার বেশি শব্দ দীর্ঘক্ষণ ধরে থাকলে কানের অভ্যন্তরীণ কোষ ও ঝিল্লির মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। সাউন্ড গ্রেনেডে উৎপন্ন ১৭০-১৮০ ডেসিবল শব্দ মানুষের শ্রবণশক্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। শুনতে পাওয়ার শক্তি সম্পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে হারানোর সম্ভাবনা থাকে। ফ্ল্যাশবাং থেকে নির্গত তীব্র আলোর ঝলক প্রায় ১ মিলিয়ন ক্যান্ডেলার সমান হতে পারে, যা অস্থায়ী অন্ধত্ব সৃষ্টি করে। যদিও এটি কিছুক্ষণের জন্য থাকে। গ্রেনেডের তীব্র আলো সংস্পর্শে চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি খুব কাছ থেকে বিস্ফোরিত হয়। সাউন্ড গ্রেনেডের হঠাৎ বিকট শব্দ ও আলোর ঝলক মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের কাজকে বিঘ্নিত করে। যার ফলে সাময়িক অস্থিরতা, মাথা ঘোরা, ও ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে।

এটি মানসিক আঘাতও সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত যারা পিটিএসডি বা মানসিক চাপে ভুগছেন তাদের মধ্যে এই প্রভাব আরও গুরুতর হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, উচ্চমাত্রার শব্দ ও আকস্মিক আলোর ফলে বুক ধড়ফড় বা বুক ধুকপুকানি বেড়ে যেতে পারে। অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণের ফলে উদ্বেগ বা আতঙ্কের লক্ষণ দেখা দেয় । শব্দের উচ্চতর তরঙ্গ কখনো কখনো শরীরের নরম টিস্যুতে আঘাত করতে পারে। এছাড়া সাউন্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণের ফলে শরীরের দুর্বল ও নাজুক টিস্যুর ক্ষতি হতে পারে। এই শব্দ যারা শোনেননি তারা কখনোই কল্পনা করতে পারবেন না। অনবরত শটগান চালালে যেমন শব্দ হয়, তেমনই শব্দ শোনা যায়।

নাগরিকদের প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?

এই ধরনের সরঞ্জাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিতভাবে ব্যবহার করেছে। প্রশ্ন উঠবেই, একটি স্বাধীন দেশে নাগরিকদের ওপর এরকম কৌশল কতটা ন্যায়সঙ্গত।

আমাদের জানতে হবে, এ ধরনের সহিংস পদ্ধতি কি সত্যিই জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর, নাকি এটি জনগণের ওপর শক্তি প্রদর্শনের একটি হাতিয়ার? সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহার, বিশেষত বিক্ষোভ ও জনসমাবেশ নিয়ন্ত্রণে বিতর্কিত ও সমালোচিত বিষয়।

বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে এই গ্রেনেডের ব্যবহার কেবল শারীরিক ক্ষতির কারণেই হয় না, এটি মানসিক ভয় ও আতঙ্কেরও উৎস হয়ে উঠেছে অনেকের মধ্যে। সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দ শারীরিক ক্ষতি না করলেও তা মানুষের মনোজগতে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। এই ধরনের সরঞ্জাম একটি আধুনিক গণপ্রজাতন্ত্রে ব্যবহারের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি আমরা।

নিষিদ্ধের আবেদন

নাগরিকদের ওপরে যথেচ্ছা ব্যবহারের কারণে এই ধ্বংসাত্মক হাতিয়ার ব্যবহার বন্ধ করতে আমরা কয়েকটি দাবির ওপর গুরুত্বারোপ করতে চাই। সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহারে হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বিক্ষোভ ও জনসমাবেশে সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহারে যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে আহত হয়েছেন, তাদের জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত। সাউন্ড গ্রেনেডের সরাসরি বা পরোক্ষ প্রভাবে যেসব নাগরিক কানে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন বা অন্য শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন, তাদের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ প্রদান জরুরি। এই দাবিটি শুধু ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য ন্যায়বিচারের অংশ নয়, বরং রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনকেও স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুলিশের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে করেই হোক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সাউন্ড গ্রেনেডকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য। রাজনৈতিক দমনের হাতিয়ার হিসেবে এই গ্রেনেড ব্যবহারের মাধ্যমে জনসাধারণের ভয়ভীতি ও চাপ সৃষ্টি করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করতে হবে। কিন্তু এ ধরনের অস্ত্রের অপব্যবহার রাজনৈতিক স্বার্থে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে।

আমরা পুলিশের সংস্কারের অংশ হিসেবে পুলিশের কেনাকাটায় উন্মুক্ত পদ্ধতি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার বিষয়টি দাবি করছি। পুলিশের মতো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সকল ধরনের ক্রয় ও অস্ত্রশস্ত্র কেনাকাটায় স্বচ্ছতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।

আমরা দেখেছি যে সাউন্ড গ্রেনেড ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটার ক্ষেত্রে বিশাল বাজেট ব্যয় হয়। এ ধরনের বাজেট বরাদ্দের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার প্রয়োজন। যাতে জনগণের ট্যাক্সের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার হয় এবং কোনো ধরনের অপচয় বা দুর্নীতি না ঘটে। পুলিশের কেনাকাটা উন্মুক্ত না থাকলে এটি জনমনে সন্দেহের জন্ম দেয় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থা কমায়।

মানবিক প্রশিক্ষণের আবেদন

পুলিশ সদস্যদের মানবিকতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদের মানবিক গুণাবলী ও দায়িত্বশীল আচরণের ওপর জোর দেয়া জরুরি। শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগ বা অস্ত্রের ব্যবহারই নয়, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদেরকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে যাতে তারা জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল ও দায়িত্বশীল থাকে। বিশেষ করে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও জনসমাবেশের সময় পুলিশকে বেশি ধৈর্যশীল হতে হবে। বিক্ষোভ বা জনসমাবেশ দমনে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ভয়ঙ্কর সরঞ্জাম ব্যবহার না করে বিকল্প মানবিক পদ্ধতির প্রয়োগ করা উচিত। পুলিশের অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টিকে আইনের কঠোর নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। পুলিশ বাহিনীকে অবশ্যই একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে রেখে অস্ত্রের ব্যবহার করতে হবে। এমন বিধ্বংসী সরঞ্জাম ব্যবহারের অনুমোদন দেয়ার আগে সুনির্দিষ্ট আইন ও প্রবিধান থাকা প্রয়োজন, যা নিশ্চিত করবে যে পুলিশ কেবলমাত্র জরুরি পরিস্থিতিতে এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করবে। এভাবে পুলিশের অস্ত্র ব্যবহারে একটি সুষ্ঠু এবং নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি নিশ্চিত করা যাবে, যা নাগরিকদের বিরুদ্ধে অপ্রয়োজনীয়ভাবে শক্তি প্রয়োগের পথ বন্ধ করবে।

একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে পুলিশ সংস্কারের দাবি বাস্তবায়নের জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা একটি মানবিক, দায়িত্বশীল ও স্বচ্ছ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাই, এমন বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন যার মাধ্যমে জনগণ ও রাষ্ট্রের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক দৃঢ় হবে। সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহার শুধুমাত্র জনগণের জন্য ক্ষতিকর নয়, এটি আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্যও হুমকি। তাই এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারে কড়া নিয়ম প্রয়োজন ও দ্রুত প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।

লেখক: এমফিল গবেষক, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই–মেইল: zahid.pen@gmail.com


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply