পাহাড় ছুঁয়ে থাকা জনপদ বিলাইছড়ি

|

কাপ্তাই হ্রদের নীল জল আর পাহাড় দেখতে দেখতে আমরা সকাল ১০টার দিকে বিলাইছড়ি পৌঁছে যাই। এক ধরনের উত্তেজনা নিয়ে নেমে পড়লাম জেটি ঘাটে। অনেক দিন পর ঘুরতে এসেছি এক ধরনের মানসিক উদ্বেল অবস্থা। ঘাট থেকে খাড়া পথ বেয়ে আপনাকে একটু ওপরে উঠতে হবে। রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট দোকান আর বাড়িঘর। ৫ মিনিট হাঁটলেই দেখতে পাবেন বিলাইছড়ি বাজার ঘিরে চারপাশে দোকান পাট। মফস্বলের গ্রাম্য বাজারের মতো। সকাল থেকে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। প্রথমেই হোটেলের খোঁজ। বাঙালিদের জন্য কয়েকটা খাবার জায়গা আছে তারমধ্যে সবচেয়ে পরিচিত বকুলের হোটেল। হোটেল দেখে আমার শহুরে চোখ হতাশ। এটাই নাকি সবচেয়ে ভালো রেস্টুরেন্ট। ঢাকা শহরের যেকোন টং ঘরের মতো। অবাক করলেও মেনে নিয়েছি খুবই সহজে। চারপাশে পানির মাঝে, শহর থেকে এতে দূরে খেতে পারবো এটাই ভাগ্য। মনে মনে খুশিও কারণ শহরের আদিখ্যেতা এখানে নেই। সকালের নাস্তা পরোটা-রুটি এসব খুঁজলাম, পেলাম না। নুডুলস পাওয়া গেলো। খুবই অবাক স্টাইলে নুডুলস রান্না! চা পাওয়া গেলো। তাও দুই রকম। একটা পাউডার দুধের অন্যটি কনডেন্সড মিল্কের। রং চা লিকারের। টি ব্যাগের সিস্টেম নাই।

উপজেলা পরিষদের সামনে গোলঘর

খাওয়া নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যথা নাই। পেটে কিছু চালান দিয়ে আমরা রেস্ট হাউজের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। এখানে তেমন থাকার সুব্যবস্থা নেই। জেলা পরিষদের একটা রেস্ট হাউজ আছে। ভিআইপি রুম ৫০০, নরমাল ৩০০ টাকা। এছাড়া নিরিবিলি ও স্মৃতিময় নামে দুটি আবাসিক হোটেল আছে। হোটেল না বলে বোর্ডিং বলা ভালো। যাইহোক আমরা রেস্ট হাউজে থেকেছি।

পাহাড় কেটে তৈরি ইট বিছানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমরা রেস্ট হাউজে পৌঁছে গেলাম। রেস্ট হাউজের শীতল আবহাওয়া মনটা ভালো করে দিলো। আমাদের ট্যুরের মূল প্লান ছিলো, ক’টা দিন শুয়ে বসে কাটাবো। চিন্তামুক্ত মাথায় বুকভরে কিছু নিঃশ্বাস নিবো। কোন ধরনের চাপ নিবো না। এটা একটি ঝিমানো ট্যুর। এসেই শুয়ে পড়লাম। একটা ঘুমও দিয়ে দিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি রুবেল ভাই নাই। জানা গেলো ভাই ছবি তুলতে গিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরেই তার হাকডাক। বিশাল এক সাপের ছবি দেখালেন। অন্তত পাঁচফুট লম্বা, তাও আবার রেস্ট হাউজের সামনের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছিলো। আমার গা টা শিরশির করে উঠলো। ভয় পেলেও আনন্দে মনটা ভরে গেলো। এটাই তো চেয়েছিলাম। মানুষ আর দেখতে চাই না। শহুরে ক্লান্ত চোখে এবার দেখবো শুধু প্রকৃতি।

বিলাইছড়িতে রবি আর টেলিটক ছাড়া অন্য কোন মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই। আমার গ্রামীন সিম নেটওয়ার্কের বাইরে। মনটা শান্তিতে ভরে গেলো। নিসর্গের কাছাকাছি আত্মভ্রমণ নষ্ট করে দিতে পারে এই মোবাইল ফোন। আমি রেস্ট হাউজে এসেই মোবাইল ফেলে রাখি। এমনকি চার্জও দেইনি। তিনদিনে আমি মোবাইল ফোনটা ছুঁয়েও দেখিনি। সময়টাও সেকারণে দারুন কেটেছে। সত্যিকথা হলো গুগল ফেসবুকের বাইরেও আমাদের একটা জীবন আছে, এটা অনেকদিন পর অনুভব করলাম। এটাই আমার ভ্রমণের তৃপ্তি কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয়।

মনে হয়েছে এতো এতো সময় হাতে, এখন কি করবো? এই বিলাইছড়িতে আমি আকাশ দেখছি, অস্তমিত সূর্য দেখছি, পাহাড়ের গাছের ফাঁকে জেগে উঠা রাতের চাঁদ দেখছি। কোমল বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে এসব অনুভব করছি। আকাশটা যে এতো বড় ঢাকায় বসে কখনও দেখতেই পারি না।

দুপুরের খাবার

গোসল সেরেই দুপুরের খাবার খেতে গেলাম। পাহাড়ী রান্না। মুলা শাক শুধু লবন দিয়ে সিদ্ধ, ঝাল শুঁটকি, জুম চালের ভাত আর মাছ। রুবেল ভাই মাছ খায় না, তার জন্য দুপুরের খাবারটা কষ্ট হয়ে গেলো। আমি দেদারসে মেরে দিলাম। ঝালে মুখ জ্বলছে। নিজের পারফরমেন্সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। খাওয়া শেষে দোকানে বসেই আড্ডা। সাথে পাহাড়ি পান। আমাদের সাথে আড্ডায় যোগ দিয়েছেন, পঞ্চাশোর্ধ এক ভদ্রলোক। তার বাড়ি বিলাইছড়িতে, চাকরি করেন সোনালী ব্যাংকে, রাঙ্গামাটিতে। গল্প গল্প করতে করতে তিনি বললেন, উপজেলার নাম হওয়ার কথা ছিলো রাইংখ্যং। কেননা এই উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর নাম রাইংখ্যং। অবশ্য নানা সীমাবদ্ধতার কারণে শেষ পর্যন্ত নামটা বিলাইছড়ি হয়ে যায়। মুলত: বিলাইছড়ি এই জনপদের পাশের একটি ঝিরির নাম। উপজেলার এমন নাম নিয়ে হাস্যরসও সৃষ্টি হয়। যেকোন প্রতিযোগিতার সময় বিপক্ষদলের সমর্থকরা এই উপজেলার খেলোয়াড় ও সমর্থকদের নাকি ম্যাও ম্যাও বলে দুয়ো দেয়।

চলছে আড্ডা

আড্ডায় একের পর এক বিষয় উঠছে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি। বিলাইছড়িতে কি আছে সে প্রসঙ্গও উঠে এলো এক সময়। বিলাইছড়ি জনপদের পেছন দিয়ে পাহাড়ের সারি রয়েছে। তার মধ্যে বেশ নামকরা চূড়া হলো পরীহোলা মইন। এ রকম নামকরণের কারণ এই পাহাড়ের চূড়ায় নাকি পরীদের আনাগানো আছে। আমরাও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম এখানে উঠে এক রাত থাকবো। এমনিতেই আকাশে বড় চাঁদ, সাথে একটা পরীর দর্শন পেলে মন্দ কি!

চলছে আড্ডা

দুপুরের পরপরই নেমে পড়লাম সদরটা ঘুরে দেখার জন্য। রেস্ট হাউজ থেকে দক্ষিণ দিকে পা বাড়ালেই সামনে পড়বে একটি সেতু। সেটা পার হলেই যে জনপদটি পড়বে তার নাম ধুপ্যাচর। পাহাড়ীদের কর্মব্যস্ততা ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একটা এলাকা। সেটা পার হতে না হতেই হাজির আরেকটি ব্রিজ। অপেক্ষাকৃত বড় এই সেতুটি পেরুলেই দীঘলছড়ি।

বিলাইছড়ি জোনে সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ক্যাম্প এই দীঘলছড়িতে। এখানেই বিলাইছড়ি ইউনিয়ন অফিস। পর্যটক মৌসুমে এখানেই ভীড় জমে অনেক ট্যুরিস্টের। ইউনিয়ন অফিসের সামনেই খেলার মাঠ। এই মাঠকে দীঘলছড়ি স্টেডিয়াম বলে স্থানীয়রা। মাঠে ভলিবল খেলা হচ্ছে। এই অঞ্চলে ভলিবল! আমি একটু অবাক হলেও রুবেল ভাই বললো, পাশেই আর্মি ক্যাম্প। সেখান থেকে এই খেলার প্রচলন ঘটে থাকতে পারে।

সবচেয়ে অবাক হয়েছি, দীঘলছড়িতে আছে একটি আবাসিক সরকারি প্রাইমারি স্কুল। তাও আবার ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত। চোখ কপালে উঠার অবস্থা আমার। দূর দূরান্ত থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে বসবাস করে পড়াশুনা করছে। ঢাকায় এরকম আবাসিক স্কুল দেখেছি, কিন্তু এখানে!! স্কুলটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম, আবাসন অবস্থা তেমন ভালো না। আমি ভাবছিলাম এই ছেলে-মেয়েরা কীভাবে থাকে। বিকেল বেলা দেখলাম ছেলে-মেয়েরা হৈহুল্লোড় করে খেলছে। মন ভালো করে দেয়ার মতো দৃশ্য। জানি না এদের মধ্যে থেকে কে কতোদূর পর্যন্ত পড়াশোনা করবে। তবুও ওদের জন্য শুভ কামনা। আমি ভাবতেই পারছি না এই বয়সে বাবা-মা ছেড়ে এরকম একটা জনবিচ্ছিন্ন পাহাড়ে স্কুলে আমি পড়াশোনা করতে পারতাম কিনা।

দীঘলছড়ি ব্রিজ

সূর্যের তেজ আস্তে আস্তে কমে আসছে। আমরাও হেঁটে হেঁটে দেখছি। দীঘলছড়ি আর ধুপ্যাচরকে একসাথে করেছে একটি ব্রিজ। ব্রিজের পাশেই ছিড়ে পড়ে রয়েছে একটা ঝুলন্ত ব্রিজ। খুবই আফসোস হচ্ছিলো। ইশ! এটা যদি ব্যবহার যোগ্য করা যেতো। এখান থেকে চারপাশটা দেখতো খুবই ভালো লাগছে। একপাশে পাহাড় আরেক পাশে লেক। লেকের অপর প্রান্তে আবার কয়েক ধাপের পাহাড়।

পাহাড়ী রাস্তা

ধুপ্যাচর আসার পর তিনরাস্তার মোড়ে এসে আমরা ডানে পাহাড়ী রাস্তা ধরলাম। এই পথ ধরেও নাকি অনেক দূর ঘুরে উপজেলা সদরের কেন্দ্রে পৌঁছে যাওয়া যায়। তাহলে আর চিন্তা কী! আমরা হাঁটা শুরু করলাম। ধীরে ধীরে উচ্চতা বাড়ছে। উচু থেকে শহরটাকে দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের মাঝপথে একটা মেয়েদের হাইস্কুল। স্কুলের কাজ এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। এখানে চারপাশটা আরও সুন্দর। মনমাতানো সবুজের মধ্যে আকাঁবাকা রাস্তা। পাহাড়ের গায়ে গায়ে সবুজের সমারোহ। দূরের পাহাড়ের চূড়ায় থেমে আছে দিগন্ত। পাদদেশের খাদে খাদে স্বচ্ছ জলরাশি। প্রকৃতির এই ছোট ছোট উপকরণ সত্যিই হৃদয় দোলানো মনোহারি।

আমরা খোলা আকাশ দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সাথে ছিলো স্থানীয় সাংবাদিক অসীম চাকমা। কথা বলতে বলতে জানা গেলো, এই যে পাহাড়ের গায়ে বড় বড় গাছ দেখতে পাচ্ছি সবই লাগানো। কিভাবে সম্ভব এভাবে লাগানো! আর কতোদিন ধরেইবা লাগিয়েছে। আরও জানালো এসব পাহাড় ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। হঠাৎ করেই আমার মনের ওপর কালো ছায়া পড়লো। আহা! যদি আমার একটি পাহাড় থাকতো।

অনেক দিন ধরে এ পথে কেউ যায় না। ঝোপঝাড়-জঙ্গলে ভরপুর। আমরা মনের আনন্দে হেঁটে চলছি। উচ্ছাস নিয়ে মাঝে মাঝে ছবিও তুলছি। কোথাও পাহাড় ধসে রাস্তা খবুই সরু। পড়লেই একেবারে শেষ। হঠাৎ করেই পাহাড়ের ঢালে দেখি একটা গরু। চোখ কুচকে ভালো করে তাকিয়ে দেখি ঘরও আছে। এখানে ঘর! আমার মাথায় প্রশ্ন ঘোরে, কেমনে ঐ ঘরে যায়, রাস্তা কই। রাতে এরকম একটা জায়গায় থাকা কি নিরাপদ। দুপুরে যে সাপের ছবি দেখেছি!

এই পাহাড় থেকে পূবদিকে আরও একটি বড় পাহাড় দেখা যায়। সেখানেও দেখি পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট ঘর। ইশ! ঢাকার মতো গিজ গিজ করা মানুষ নেই, গাড়ির শব্দ নেই। যতই দেখছি ততই আফসুস বেড়েই চলছে। আমরা প্রায় এক ঘণ্টার ট্রেইল করে শহরের অপরপ্রান্তে পৌঁছলাম। অসাধারণ সময় কাটলো। বাহিরে আমি থাকলেও মনের ভিতর অন্য জগত!!!

পাহাড়ের গায়ে বিকেলের রোদ পড়ছে। ম্লান সূর্যের কমে আসছে আলো। আকাশ জুড়ে সন্ধ্যা ছুই ছুই। এমন গোধুলী উপভোগের জন্যই হয়তো, এই শহরের টিনের চাল আর কাঠের তৈরি তিনটি গোলঘর রয়েছে। একটি থানার সামনে আরেকটি উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনে অন্যটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনের পাশে। আমরা তৃতীয় গোল ঘরটায় সন্ধ্যা দেখতে আসলাম। এখানে বসে থাকলে মনটা ভালো হয়ে যেতে বাধ্য।

শেষ বিকেলের আলো মেখে অবসন্ন পৃথিবীর মতো আমরাও বিশ্রামের লোভে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। চোখের সামনে দেখছি সূর্যের সোনালি রঙের ছোঁয়ায় নিবিড় প্রশান্তি নামছে পাহাড় জুড়ে। সারাদিনের তেজদীপ্ত সূর্য এখন রক্তিম আভার ঘোমটা পড়ে লজ্জাবনত, কোমল। পাহাড়ের বুকে সূর্যাস্ত, রক্তিম সূর্যের রক্তিম আভা চারপাশে। আমাদের ঘিরে সূর্য ডোবার আয়োজন। পৃথিবীর বুকে বিদায় নিচ্ছে আরও একটি কোলাহলমুখর দিন। চিরকাল মনে রাখার মত একটা স্বর্গীয় দৃশ্য।

উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসভবনের পাশের গোলঘর থেকে

এই সুর্যাস্তকে যান্ত্রিকতায় ধরে রাখার জন্য ভিডিও করতে থাকলাম। একটা টাইমল্যাপস ভিডিও বানানোর চিন্তা থেকে। হঠাৎ করেই আমি চোখ বন্ধ করে থাকলাম। তারপর কিছুক্ষণপর ধীরে ধীরে চোখ খুললাম। চোখে পড়লো দুপুরের সবুজাভ পাহাড়ের আড়ালে কর্মক্লান্ত রক্তিম সূর্য মুখ লুকাচ্ছে, কালো ছায়ার মতো পাহাড় আর গাছ দাঁড়িয়ে। ডুবে যাওয়া সূর্যের লাল-সোনালি-হলুদ আলোর রশ্মির রেখা ছড়িয়ে রয়েছে আকাশজুড়ে। লেকের পানি ঢেউহীন শান্ত। শেষ বিকেলের ঝিরঝিরে শীতল কোমল হাওয়ায় নড়ছে গাছের পাতা। পাহাড়ের পিছনের আকাশে সোনালি আলোর অপূর্ব রূপের ছটা। ডানায় সোনালি আলোর ছোঁয়ায় পাখিরা নীড়ে ফিরছে। আমি চোখের পলক ফেলছি না যদি কিছু মিস করে ফেলি। কিছুক্ষণ পর যান্ত্রিক আওয়াজ তুলে কিছুটা দূরে হ্রদের বুকে জলের ওপর ঢেউয়ের রেখা টেনে ট্রলার চলে গেলো।

সুর্যাস্তের সাদা-কালো ছবি

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে নীল জলের পানি হলুদ থেকে লাল হয়ে অন্ধকারে কালো হয়ে যাচ্ছে। এক কথায় অসাধারণ, এতো সুন্দর!! বিমোহিত, মুগ্ধ। ঐশ্বরিক উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা। সব ক্লান্তি দুর হয়ে গেল নিমিষেই। আমার এখন থেকে উঠতেই ইচ্ছে করছিলোনা। অপার বিস্ময়ে এক ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের মায়ায় আটকে পড়ি।

একটা ঘোরের মধ্যে থেকে রেস্ট হাউজে ফিরে আসলাম। এসেই শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়েও গেলাম। সবকিছু কেমন জানি অদ্ভুতভাবে ঘটছে। সন্ধ্যার সময় ঘুম! রাত ৯টার দিকে উঠে খেতে গেলাম। রেস্ট হাউজ থেকে বের হয়েই আমি চিৎকার দিলাম। ইয়া আল্লাহ! তারাভরা আকাশ। মোহনীয় বিস্তীর্ণ অন্ধকারের জ্বলেছে তারা। কি সুন্দর আকাশ! কি মনোমুগ্ধকর এ পৃথিবী!

আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থেমে যাই, ভীষণ শীতের তারায়-ভরা রাতের আকাশ। শহুরে কৃত্রিম আলোর প্রহসনে কতোদিন দেখিনি নক্ষত্রের শুদ্ধ আলোর রহস্যময় রাতের আকাশ। উহ! অসহ্য সুন্দর নক্ষত্রখচিত আকাশ। ঝিকমিক করছে তারা। সারা আকাশটা মনে হচ্ছে জ্বল জ্বল হীরে বসানো কালো কোমল চাদর। আমার ইচ্ছে করছিলো এই চাদর গায়ে জড়িয়ে অনন্ত ঘুম দেই। মনে মনে ভাবছিলাম এবার ঢাকায় গিয়ে এই নক্ষত্রদের নিয়ে পড়াশোনা করবো।

রেস্ট হাউজে ফেরার পথে উপজেলা পরিষদের সামনের গোলঘরে আমরা বসলাম। মেঘহীন তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। আশে পাশের অন্ধকারের পাহাড় দেখি। চারপাশের নির্মল প্রশান্তি ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হচ্ছে হৃদয় জুড়ে। রাতের নিস্তব্ধতার সাথে ফুটফুটের তারার মেলা। আমার সৌন্দর্যের মাদকতায় নেশাগ্রস্তের মতো লাগছিলো। এরমধ্যে চলছে আড্ডা, ছবি তোলা। হঠাৎ করেই আমাদের মনে প্রশ্ন উঠলো সামনের পাহাড়ের চূড়ার ওপাশে আলোর ছটাটা আসলে কি। কেননা ঐ পাহাড়ের আড়ালেতো কোন শহর নেই, তাহলে এই আলো কীসের?

উপজেলা পরিষদের সামনের গোলঘর

হঠাতই চোখে পড়লো সেই পাহাড়ের পেছনে থেকে চাঁদ উকি দিতে শুরু করেছে। অনেকটা সূর্যোদয়ের মতোন। কি ভয়ঙ্কর সুন্দর। আমরা যে আলোর ছটা নিয়ে ভাবছিলাম সেটা আসলে ছিলো চাঁদ! ধীরে ধীরে চাঁদ পাহাড়ের আড়াল থেকে খোলা আকাশের দিকে উঠছে। পাহাড়ের জোসনা ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের। পরিষ্কার আকাশের চাঁদের স্নিগ্ধ আলো আচ্ছন্ন করে ফেলছে আমাদের।

ইশ! সময়টা এখানেই থামিয়ে দেয়া যেতো। সুনসান নিরব, চাঁদের আলোয় কয়েকটি যুবক!!! আমার ইচ্ছে করছে রুপালী চাঁদের জ্যোৎস্না বিলাসে কেউ একজন আমার হাতটা ধরুক। খুব স্পর্শকাতর সুরে বাঁশি বাজবে। আমি তার সাথে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যাবো।

আমরা চেষ্টা করছিলাম এই সুন্দর চাঁদটাকে ধরে রাখতে। কিন্তু ক্যামেরা রেস্ট হাউজে। কি আর করা মোবাইল দিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা। রুবেল ভাই অক্লান্ত ধৈর্য ধরে ছবি গুলো তুলে দিলেন। আমরা একটা ছবি তুলছি আর উচ্ছাস প্রকাশ করছি।

আমার কোনভাবেই রেস্ট হাউজে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে এইখানে শুয়ে থাকি। আর চাঁদের আলো খাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রেস্ট হাউজে যাই। শুয়ে পড়ি। নিঝুম প্রকৃতির মাঝে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানা নেই।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply