ইশতিয়াক আহমাদ :
প্রাকৃতিক মুগ্ধতা মানুষকে মেরেও ফেলতে পারে। এই ধারণা প্রথমবার আমার মনে বদ্ধমূল হয় বিখ্যাত পরিচালক আলফ্রেড হিচকক -এর রেবেকা (১৯৪০) দেখার সময়। কোনো এক উচুঁ খাড়া পাহাড়ের প্রান্তে দাঁড়িয়ে নায়ক যখন নিচে তাকিয়ে সমুদ্রের ঢেউ যেখানে আছড়ে পড়ছে পাথরের উপর ঠিক সেখানে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার চিন্তা করছিল।
দিগন্ত জোড়া সমুদ্রের মোহ, পেছনে পাহাড়ের বিস্তৃতি, বাতাসের ঝাপটা আর ঢেউয়ের মুহুর্মুহু আবেশি শব্দ-মনে হচ্ছিল নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার জন্য এরচেয়ে মধুর সময় বা সুযোগ আর হয় না। যদিও সিনেমাটা সাদাকালো ছিল। কিন্তু এবার কেওক্রাডং থেকে ফেরার সময় চোখের সামনে যখন পশ্চিমাকাশ গোধূলি রঙে রঙিন হয়ে উঠছিল আর সারাদিনের পাহাড় ডিঙানো পা দুটি ক্লান্ত, অবসন্ন; যখন ঘন জঙ্গল সন্ধ্যার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আসছিল; ঝোপের মধ্যে মুহুর্মুহু ডেকে উঠছিল তক্ষক, তখন এই প্রাকৃতিক সিদূর রঙ, এই কালো-সবুজ বন, এই পাহাড়ের ভাঁজ, এই তীব্র থেকে তীব্রতর চিত্তহারিশব্দে আমি মরে যাব। হয় আমি আত্মহত্যা করবো, না হয় এই সুন্দর আমাকে জোর করে মেরে ফেলবে।
না, শেষ পর্যন্ত কোনটাই হয় নি। আমি এখনো বেঁচে আছি। সুস্থ আছি। এর কারণ আমার সঙ্গীরা, নয় পাহাড় ডিঙানো অভিযাত্রীরা। তারা আমাকে তাড়া না দিলে আমি হয়তো ঐ পাহাড়ের ছোট্ট পাথরের উপর বসে আত্মহারাই হয়ে রইতাম।
আমাদের ছোট্ট একটা দল আছে, ডিকে ওয়াকস (Dk Walks) নামে। যারা কোনো কারণ ছাড়াই হাঁটাহাঁটি করি। মন চাইলেই ২/১ দিনের পরিকল্পনায় হেঁটে বেড়াই পুরো শহর। নয়তো চলে যাই দূরের কোনো জল-জঙ্গলে।
এবারে মন ছিল পূর্ণিমা স্নান করবো বান্দরবনের বগা লেকে। পাহাড়ের উপর পানি তার উপর পূর্ণ চাঁদ, কল্পনা করতেই আমরা ঢাকার অমাবশ্যাতেও ভেসে যাচ্ছিলাম চন্দ্রালোকে।
ঢাকা থেকে রাতের বাসে করে সকালে পৌঁছলাম বান্দরবান। লোকাল বাসে রুমা বাজার পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর। গাইড আমাদের নিয়ে শুরু করে দিলেন রীতিমতো দৌড়াদৌড়ি। প্রশাসন, আর্মি, পর্যটন এসবের অনুমতি শেষ করে দুপুরের খাবার খেলাম সেই দৌড়ের মধ্যেই। এরপর চান্দের গাড়িতে উঠে সোজা কমলা বাজার। এরমধ্যে নিয়ে নিলাম বিশেষ পদ্ধতিতে প্যাকিং করা ১ হালি মুরগি আর বার-বি-কিউ করার জন্য যাবতীয় জিনিসপত্র। ভাঙা রাস্তায় কমলা বাজার পৌঁছুতেই হয়ে গেল বিকেল। এরপর আর গাড়ি যাবে না। পা দুটোই একমাত্র অবলম্বন। একটা খাড়াপাহাড় উঠলেই বগা লেক। আমাদের আপাত গন্তব্য। কিন্তু টানা ভ্রমণের পর এই খাড়া আকাশযাত্রা, স্বাভাবিকভাবেই সবার শরীর নিতে পারছিলো না। একটুখানি উঠেই একেকজনের চোখমুখ উল্টে যাবার মতো অবস্থা। দরদর করে ঘাম ঝরছে অনবরত।
আমাদের গাইড তৌহিদ একটু পরপর দাঁড়িয়ে দম নেয়ার সুযোগ দিচ্ছে সবাইকে। আমাদের সবাইকে হতবিহ্বল করে দিয়ে হঠাৎ করেই সামনে এলো বগা লেক। সবাই ভেবেছিল আরো কতক্ষণ পাহাড় বাইতে হয় কে জানে, এত দ্রুত মাত্র ২৫ মিনিট হেঁটেই গন্তব্যে পৌছে যাব তা কল্পনারও বাইরে ছিল। লেকের পাড়ে বসে কাটিয়ে দিলাম শেষ বিকালের কিছুটা সময়।
সোনালি রোদ পানি আর সবুজ পাহাড়কে অনন্য রূপ দিয়েছে, সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে চোখ দিয়েছেন তা দেখার জন্য। আমরা দেখছি, মুগ্ধ হচ্ছি, আমাদের সব ক্লান্তি ঠাণ্ডা বাতাসে উড়ে যাচ্ছে, আমরা শক্তি সঞ্চার করে লেকের অপর পাড়ে হেঁটে যাচ্ছি।
আমাদের কটেজটা ছিল ঠিক লেকের পাড়েই। বাঁশের মাচা, বাঁশের বেড়া, বাঁশের দরজার তৈরি কটেজ। হাঁটলেই মচমচ করে ওঠে। একটু নড়লেই খচখচ করে ওঠে। যখন মচমচ করে হেঁটে রুম পেরিয়ে বারান্দায় গেলাম, লেক আর পাহাড় দেখে মনটা নেচে উঠলো। সারা রাত পূর্ণিমা চাঁদ দেখার জন্য এরচেয়ে সুন্দর বারান্দা আর হয় না।
বগাকাইন লেক বা বগা হ্রদ বা স্থানীয় নামে বগা লেক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার স্বাদু পানির একটি হ্রদ। বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে বগাকাইন হ্রদের অবস্থান কেওক্রাডং পর্বতের গা ঘেঁষে, রুমা উপজেলায়। ফানেল বা চোঙা আকৃতির আরেকটি ছোট পাহাড়ের চূড়ায় বগা লেকের অদ্ভুত গঠন অনেকটা আগ্নেয়গিরির লালামুখের মতো।
এই হ্রদটি সম্পূর্ণ আবদ্ধ — এ থেকে পানি বের হতে পারে না এবং কোনো পানি ঢুকতেও পারে না। আশেপাশে পানির কোনো দৃশ্যমান উৎসও নেই। হ্রদের পানি কখনও পরিষ্কার আবার কখনওবা ঘোলাটে হয়ে যায়। কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন এর তলদেশে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ রয়েছে। এই প্রস্রবণ থেকে পানি বের হওয়ার সময় হ্রদের পানির রঙ বদলে যায়।
সন্ধ্যায় ছুঁইছুঁই, সবাই দলবেঁধে নেমে পড়লাম বগা লেকে গোসল করতে। যদিও নিরাপত্তার কারণে এখানে সাঁতার কাটা সম্পূর্ণ নিষেধ। রুমা থেকে আসার সময় প্রশাসনের কাছে লেকে সাঁতার কাটবো না এবং পানিতে নেমে মৃত্যু হলে নিজেই দায়ী থাকবো বলে মুচলেকাপত্র দিয়ে এসেছি সবাই। তবুও সাঁতার জানা মানুষ এই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসা অন্ধকারেও স্বচ্ছ পানি দেখে হাত পা না ছুঁড়ে থাকতে পারবে না। পানির নীচে প্রচুর লতাগুল্ম। যেহেতু প্রচলিত আছে এটি একটি আগ্নেয়গিরির লাভামুখ। হয়তো এক সময় আবার এই সুপ্ত আগ্নেয়গিরি জ্বলে উঠবে। এই লেক হয়ে যাবে অধরা।
রাত নেমে আসলো পাহাড়ে। বগাকাইন লেক পাড়া সরব হয়ে উঠলো পর্যটকের পদচারণায়। পূর্ণিমা বলে এই দিন পর্যটকের সংখ্যা একটু বেশিই বলা চলে। পাড়ার বিশাল মাঠের চারপাশ জুড়ে চলছে পূর্ণিমা বরণের প্রস্তুতি।
কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে দলবেঁধে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ জ্বলজ্বলে আগুন ঘিরে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ গিটারে টুংটাং করছে, কেউ ক্যামেরার সেটিংস ঠিক করে ২/১ টা ক্লিক করছে। এদিক সেদিক, কেউ হুদাই এইসব দেখছে, কেউ এলোমেলো হেঁটে বেড়াচ্ছে শিশির ভেজা দূর্বা ঘাসে পা ঘষে ঘষে, কেউ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পূবের আকাশে, ঐ তো পাহাড়ের চূড়ায় হালকা রূপালি আভা দেখা যাচ্ছে। একটু পরেই আমাদের ডুবিয়ে দেবে রূপার দেশে।
পুরো পাড়া কিছুক্ষণের মধ্যেই চাঁদের আলোয় ঝকমকিয়ে উঠলো। বিশাল চাঁদখানা হালকা সাদা মেঘের আবরণে জড়িয়ে মেঘে মেঘে ছেয়ে ফেলছে আকাশ, আলোকিত করছে আমাদের চারপাশ। আমাদের গাইড তৌহিদ এক কোনায় আগুন জ্বালিয়েছে। ওখানে বারবিকিউ হবে। আমরা কিছুক্ষণ শরীর গরম করে, এক কাপ কফি পান করে চলে এলাম একটু নির্জন জায়গায়। যেখান থেকে চাঁদ দেখা যাবে আপন করে। এই চাঁদ দেখে কারো প্রতিভা লুকিয়ে রাখা সম্ভব না। গায়কেরা গুনগুন করে গেয়ে উঠলো গান। বাকীদের প্রবল উৎসাহে সেই গান হয়ে উঠলো সকলের নেশা।
সাদিয়া, নীলুফা, বাঁধন, শ্যামল, তাহমিনা গলা মিলিয়ে কখনো একা, কখনো সমবেত কণ্ঠে গেয়ে যাচ্ছে গান। আহা কি মধুর সেই সুর লহরী যেন চাঁদের আলোকে করেছে আরো বেশি সুললিত। আমরা হালকা শিশির ভেজা ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে গানের গল্পে নিমজ্জিত হয়ে চাঁদের আলোয় করছি স্নান। এই স্মৃতি আমরণ থাকবে ভাস্বর।
কিভাবে ২/৩ ঘণ্টা কেটে গেল টের পাইনি। গাইড এসে ডাকলো রাতের খাবারের জন্য। ডাক পেয়েই ক্ষুধা টের পেলাম সকলেই। খেতে বসে আগুন ঝলসালো ধোঁয়াটে স্বাদের মাংসে যেন সেই ক্ষুধা বাড়িয়ে দিল বহুগুণ। সিয়াম দিদির ডাইনিং টেবিলটা তখনো ঝলমল করছে চাঁদের আলোয়। আহা চাঁদ!
প্রায় মধ্যরাতে সবাই পশ্চিমমুখী বারান্দায় গোল হয়ে বসে লেকের পানি দেখছি। চাঁদ তখনো পূব আকাশে তবে চাঁদের আলো ফকফকা করে রেখেছে লেককে। সবাই চাঁদের অপেক্ষা করতে করতে দুই দলে ভাগ হয়ে গানের কলি খেলছি। এই প্রতিযোগিতা খুনশুটি করার জন্য উত্তম। এই খেলা খেলতে খেলতে চাঁদ মাঝগগনে। কেউ কেউ ঘুমে কাঁতর একে তো ক্লান্ত শরীর তার উপর পরের দিন যাবো কেওক্রাডং, সেই ধকল সামলানোর প্রস্তুতি। একমাত্র ঘুমেই যা সম্ভব।
তবে যারা ঘুমায় নি তারা এই প্রস্তুতি নিয়েছে পূর্ণিমার আলো মেখে। মধ্যরাত পেরিয়ে পশ্চিম দিকে যখন হেলে পড়েছে গোটা চাঁদ, তখন এদের চোখে মুখে নবদীপ্তি। রূপোলি চাঁদ ক্ষণে ক্ষণে রঙ পরিবর্তন করে সোনা ঝরা স্বর্ণাভাব। ছড়িয়ে যাচ্ছে দিগন্তে। দূর পাহাড়ের কালো রেখা আপন করে জড়িয়ে নিচ্ছে বুকে। প্রকৃতির এই উদার সৌন্দর্য ছড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের মনে। প্রশান্ত করছে শরীর। আবেশে নির্ঘুম চোখ বগা লেকের পানিতে খুঁজে ফিরছে আরো একটি চাঁদের ছায়া। জীবন এখানে অর্থময়, দিন এখানে উপলক্ষ্য মাত্র, রাত এখানে সঞ্জীবনীর উপাখ্যান।
যমুনা অনলাইন: আইএ/টিএফ
Leave a reply