বুড়িগঙ্গায় ডিঙ্গি নৌকায় নদী পাড়ি, বছরে শতাধিক মানুষের সলিল সমাধি

|

নগরীর সদরঘাটের বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় করে নদী পাড়ি দেয়ার সময় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। ওইসব দুর্ঘটনায় বছরে শতাধিক মানুষের সলিল সমাধি হচ্ছে। তবুও বন্ধ হচ্ছে না ঝুঁকিপূর্ণ পারাপার।

অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিষেধ অমান্য করে লঞ্চঘাটের আশপাশের গুদারাঘাটগুলো থেকে খাস আদায় অব্যাহত রাখায় লঞ্চ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ নৌকা পারাপার বন্ধ করা যাচ্ছে না।

অবিলম্বে লঞ্চ টার্মিনালের আশপাশের নৌকার ঘাটগুলো বন্ধ করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

ঢাকা নদী বন্দরের লালকুটিঘাট থেকে ওয়াইজঘাট পর্যন্ত নদী পারাপারের জন্য তিনটি গুদারাঘাট রয়েছে। এসব ঘাট থেকে ডিঙ্গি নৌকায় নদী পারাপার হতে গিয়ে লঞ্চের ধাক্কায় প্রাণহানি ঘটছে।

নৌ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ওই পয়েন্ট দিয়ে নৌকায় পার হতে বছরে শতাধিক মানুষের করুণ মৃত্যু হচ্ছে। কোনো কোনো সময় লাশও খুঁজে পাওয়া যায় না।

এরমধ্যে শুক্রবার সকালে নৌকায় পার হওয়ার সময় লঞ্চের ধাক্কায় মিশকাত (১২) ও নুসরাত (৯) নামে দুই সহোদরের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ১২ জুন নৌকায় পার হওয়ার সময় ছানিয়া (৯) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

১৫ এপ্রিল রাতে নদী পার হওয়ার সময় বাল্কহেডের ধাক্কায় যাত্রীবাহী ট্রলার উল্টে মেহেদী হাসান (৮) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ওই সময় আরও ১০ জন যাত্রী আহত হয়।

নদী পারাপারের ঘাটগুলো আরও পূর্ব ও পশ্চিম দিকে সরিয়ে নিতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও স্থানীয়দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সাল থেকে সরকারি ডাক বন্ধ করে দেয়া হয়।

এরপর থেকে বিআইডব্লিউটি’র বন্দর শাখার কর্মকর্তারা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে ওই ঘাটগুলো থেকে খাস আদায়ের নামে প্রতিদিন লাখ টাকা উত্তোলন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটি নৌকা থেকে দিনে ১৬০ টাকা করে খাস আদায় করা হয়।

এ ঘাটগুলোতে প্রতিদিন তিন শতাধিক নৌকা চলাচল করছে। এসব নৌকা কতজন যাত্রী বহন করতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। তাই মাঝিরা ইচ্ছেমতো যাত্রী বোঝাই করে নদী পাড়ি দিচ্ছে।

সরেজমিন সদরঘাটের খেয়াঘাটগুলোতে দেখা যায়, প্রতি নৌকায় ৫-৬ জন যাত্রী নিয়ে চলন্ত লঞ্চের ফাঁক গলে ঝুঁকি নিয়ে যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে। আবার বিভিন্ন গন্তব্য থেকে লঞ্চ এলেই ছোট ডিঙ্গি নৌকাগুলো কার আগে কে যাত্রী উঠাবে এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে।

এছাড়া সংকীর্ণ এ নদীটি দিয়ে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে রাতের বেলায় বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল করছে। এতে দুর্ঘটনার মাত্রা আরও বাড়ছে বলে জানায় স্থানীয়রা। কয়েক মাসে নদী পার হতে গিয়ে বাল্কহেডের ধাক্কায় নৌকা ডুবিতে অন্তত ২০ ব্যক্তি নিহত হয়েছে বলে জানান তারা।

লালকুটিঘাট থেকে ওয়াইজঘাট পর্যন্ত ৩টি পয়েন্ট দিয়ে শত শত নৌকা সিরিয়াল করে যাত্রী পার করছে। প্রতিটি খেয়া নৌকা পানি ছুঁই ছুঁই করে মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে নদী পার হচ্ছে। একটি নৌকার সঙ্গে আরেকটি মুখোমুখি সংঘর্ষ হচ্ছে।

নুর ইসলাম, আবু হানিফ ও হজরত আলী নামে কয়েকজন মাঝি বলেন, লঞ্চের মাস্টাররা প্রায়ই নৌকার ওপর লঞ্চ উঠিয়ে দিচ্ছে। এতে মানুষ মারা যাচ্ছে ও ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।

ঢাকা থেকে চাঁদপুরগামী রফরফ ২ লঞ্চের মাস্টার হারুনুর রশীদ বলেন, প্রায়ই মাইকে ছোট নৌকাগুলোকে লঞ্চের আশপাশে আসতে নিষেধ করা হলেও মাঝিরা নিষেধ না শুনার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।

তাছাড়া কয়েক বছর থেকে খেয়াঘাটগুলো সরানোর কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থার সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমদ বলেন, লঞ্চঘাটের ভেতর দিয়ে চলাচলরত নৌকা ঘাটগুলোকে সরানোর জন্য আমরা দফায় দফায় বিআইডব্লিউএকে অনুরোধ করেছি। কিন্তু অদৃশ্য কারণে খেয়াঘাটগুলো সরানো হচ্ছে না।

সদরঘাট নৌ থানার ওসি রেজাউল করীম ভুইয়া বলেন, নৌ দুর্ঘটনা রোধে যাত্রীদের সতর্ক করা হচ্ছে। পাশাপাশি খেয়া পারাপারের ঘাটগুলোকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে বিআইডব্লিউকে লিখিত ও মৌখিকভাবে বলা হয়েছে বলে জানান তিনি।

ঢাকা নদী বন্দরের যুগ্ম-পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন বলেন, প্রথম থেকে এ খেয়াঘাটগুলো সরানোর জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। লঞ্চঘাটের মাঝখান থেকে ৫০ মিটার পূর্ব দিকে স্থানান্তর করতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু স্থানীয় চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন ও আলম মার্কেটের একজন নেতার জন্য ঘাটটি সরানো যাচ্ছে না। তারা এতদিন বলেছে, আমরা সতর্কভাবে নৌকা পরিচালনা করি। কিন্তু এখন যে কোনো দুর্ঘটনার দায় তাদেরকেই নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সূত্র: যুগান্তর


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply