কামাল হোসাইন,নেত্রকোণা
আজ রোববার। শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে হামলা ট্যাজেডির তিন বছর আজ। ২০১৬ সালের ওই দিনে দেশের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে ঈদুল ফিতরের জামাতের আগে মাঠে প্রবেশ পথের সবুজবাগ সংযোগ সড়কে মুফতি মোহাম্মদ আলী জামে মসজিদের সামনের তল্লাশি চৌকিতে ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে।
এ সময় জঙ্গিদের ছোঁড়া গ্রেনেডে, গুলি ও চাপাতির আঘাতে নেত্রকোণার মদনের পুলিশ কনস্টেবল আনছারুল নিহত হন।
সেই শোকে দু’চোখের পাতা আজো এক করতে পারছেন না আনছারুলের মা রাবেয়া খাতুন। তিনি জানান,“আমার হুত আমারে না বলছিল, মা আমি ঈদের নামাজ পড়েই বাড়ি আইব,তিন বছর হয়ে গেল অহনও আইলনা।”
দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামায়াত কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া মাঠের কাছে জঙ্গি হামলার ঘটনায় নিহত হন পুলিশ কনস্টেবল আনছারুল হক (২৭) এ উপলক্ষে রোববার তার গ্রামের বাড়ি মদন উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। পরিবারের পক্ষে আনছারুলের ছোট ভাই আইনুল হক সকলকে উক্ত দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে অংশ গ্রহণ করে মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।
ঈদের দিন সকাল সাড়ে ৭ টায় মা রাবেয়া খাতুনের সাথে কথা হয় আনছারুলের। ঈদের ছুটি হয়েছে, ঈদগাহ মাঠের ডিউটির পর বাড়ি আসবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। পরিবারের সাথে ঈদ উদযাপন করা হলো না। ওই দিন আসতে হল লাশ হয়ে। শুধু মা রাবেয়া নয়, পুরো পরিবার এখন বেচেঁ আছে আনছারুলের স্মৃতি আকঁড়ে ধরে।
শনিবার ৬ জুলাই গ্রামের বাড়িতে কথা হয় পুলিশ কনস্টেবল আনছারুলের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।
তারা জানায়, আনছারুল নিঃসন্তান ছিলেন। তার স্ত্রী নূরন্নাহার এখন আর তাদের পরিবারে খুব একটা আসেন না বিশেষ কোন কাজ ছাড়া।
রোববার সকালে আনছারুলের বিষয়ে জানতে চাইলে মা রাবেয়া আক্তার বলেন, “তিন বছর হয়ে গেল এখনও চোখের পাতা এক করতে পারি না,এই কারবালার মাঠ আমার জন্যই হয়েছে,আমার পুত এক মাস রোজা রেখেছিল সে বলেছিল ঈদের ছুটি হয়েছে মা,মাঠের ডিউটির পর আসব। এসে তোমার সাথেই খাইব। খাওয়া আর হলো না। আমার পুত আসল লাশ হয়ে।
তিনি আরও বলেন, আমার আনছারুলেই ছিল এই পরিবারের একমাত্র আয় রোজগারের উৎস। তার বাবা মারা যাওয়ার পর সেই পরিবারের হাল ধরে। ভাগ্যক্রমে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার দেখা হয়েছিল (২৮ ডিসেম্বর ২০১৬) আমি বলতে হারি নাই,আমার আর একটা পুত আছে,তার যোগ্যতা অনুযায়ী একটা চাকরির ব্যবস্থা করলে এই পরিবারটি বাইছে যাইত। আমার পুতে হাজার হাজার মানুষের জীবন বাচাইছে, প্রধানমন্ত্রী আমার এই হোলারে একটা চাকরি দিয়ে কয়েক জনের জীবন বাচাক, এইডা আমার প্রধান মন্ত্রীর কাছে দাবি থাকব। আমার ছোট ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন জায়াগায় গিয়েছি। অবশেষে পুলিশ সুপার শান্তনা স্বরুপ আমার ছেলেকে আউট সোর্সিং এ পরিছন্ন কর্মী হিসেবে ১২ হাজার টাকা একটি চাকুরী দেন। যে টাকায় আমার সংসারের কিছুই হয় না। এ পদে চাকুরী আমি লোকে মুখে বলতেও পারি না।
আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে তাদের আমি ফাসিঁ চাই। তিন বছর হয়ে গেলে এখন পর্যন্ত খুনিদের কোন বিচার হল না।”
সেদিনের স্বজন হারানোর দুঃসহ স্মৃতি আর দেশ কাঁপানো বীভৎস ঘটনা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় আনছারুলের পরিবার। এ ধরণের নৃশংস ও বর্বরোচিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন আনছারুলের পরিবারের লোকজন।
আনছারুলের বিষয়ে মোবাইল ফোনে স্ত্রী নূরন্নাহারের কাছে জানতে চাইলে তিনি ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “আমার সংসার জীবন উনার সাথে ৯টি বৎসর কেটেছে, কোনদিন সংসারে ঝগড়া হয়নি। কাহারো সাথে খারাপ আচরণ করতে দেখিনি। তিনি নিজের পরিবার নিয়ে সব সময় চিন্তিত থাকতেন।”
নেত্রকোণার মদনে ২১ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে দৌলতপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন আনছারুল। ২৬ অক্টোবর ২০০৬ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। সফলভাবে ট্রেনিং সমাপ্ত করে তিনি কৃতিত্বের সাথে ডিএমপি,ঢাকা,আরআরএফ,সিলেট, মৌলভী বাজার এবং কিশোরগঞ্জ জেলায় দায়িত্ব পালন করেন। কর্ম জীবনে তিনি ১৪টি উত্তম পুরস্কারে ভূষিত হন।
Leave a reply