ভারতের কেন্দ্র শাসিত জম্মু ও কাশ্মিরের ‘বিশেষ’ রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করা হয়েছে। এতদিন, ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সীমিত আকারে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের মর্যাদা ভোগ করে আসছিল কাশ্মির। সোমবার, ভারতের রাজ্যসভায় কাশ্মিরের এই মর্যাদা বাতিলের ও ভারত অধিকৃত কাশ্মিরকে দুইভাগে ভাগ করার প্রস্তাব করে কেন্দ্রীয় সরকার। এতে লাদাখ ও জম্মু কাশ্মিরকে আলাদা আলাদা অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। উভয় অঞ্চলই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা শাসিত হবে। জম্মু ও কাশ্মিরের নিজস্ব একটি আইনসভা থাকবে কিন্তু লাদাখের কোনো আইনসভা থাকবে না। এসব প্রস্তাব আকারে রাজ্যসভায় পেশ করার কিছুক্ষণ পরই ভারতের রাষ্ট্রপতি রাজনাথ কোবিন্দ এ সংক্রান্ত নোটিফিকেশনে স্বাক্ষর করেছেন। যদিও প্রস্তাব উত্থাপনের সময় এর বিরোধীরা ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছে, তবে ধারণা করা হচ্ছে, রাজ্যসভা ও বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে বিলটি পাস হবে।
এক নজরে জেনে নেয়া যাক কাশ্মির সম্পর্কে। জানা যাক, জম্মু-কাশ্মির কীভাবে ভারতের হলো।
ভৌগলিক অবস্থান:
কাশ্মির অঞ্চলটি প্রধানত হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত। ভারতের এই কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলটির দক্ষিণে ভারতের ‘হিমাচল প্রদেশ’ ও ‘পাঞ্জাব’ রাজ্য দুটি অবস্থিত। জম্মু ও কাশ্মিরের উত্তরে ও পূর্বে গণচীন অবস্থিত। এই অঞ্চলের পশ্চিমে ও উত্তরপশ্চিমে ‘লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোলের’ ওপারে কাশ্মিরের পাকিস্তান-শাসিত অংশ আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিত-বালতিস্তান অবস্থিত।
কাশ্মির নিয়ে দড়ি টানাটানি:
বর্তমান জম্মু ও কাশ্মির ভূখণ্ডটি অতীতে ‘কাশ্মির ও জম্মু দেশীয় রাজ্যে’র অধীনস্থ ছিল। এই রাজ্যের শাসকেরা ঐতিহাসিক বৃহত্তর কাশ্মির অঞ্চল শাসন করতেন। এখন কাশ্মির অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে বিবাদ রয়েছে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যটি ‘ভারত-অধিকৃত কাশ্মির’ বা ‘ভারত-শাসিত কাশ্মির’ নামে পরিচিত। অন্যদিকে, পাকিস্তানের শাসনাধীনে থাকা অংশটি ভারতে ‘পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মির’ এবং পাকিস্তানে ‘আজাদ জম্মু ও কাশ্মির’ নামে পরিচিত।
ভারত শাসিত কাশ্মির:
জম্মু, কাশ্মির উপত্যকা ও লাদাখ- এই তিন অঞ্চল নিয়ে জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যটি গঠিত। এই রাজধানী দুটি। ‘শ্রীনগর’ এই রাজ্যের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী এবং ‘জম্মু’ শীতকালীন রাজধানী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য কাশ্মির উপত্যকা বিখ্যাত। কাশ্মিরকে ‘ভূ-স্বর্গ’ও বলা হয়ে থাকে। ‘জম্মু’ অঞ্চলে অনেক হিন্দু মন্দির থাকায় এটি হিন্দুদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। আর লাদাখ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। একে ‘ছোটো তিব্বত’ নামেও ডাকা হয়ে থাকে।
যেভাবে কাশ্মির ভারতে অধীনস্থ হলো:
১৯২৫ সালে হরি সিং কাশ্মিরের রাজা হন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভের আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন কাশ্মিরের শাসক। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের অন্যতম শর্ত ছিল, ভারতের দেশীয় রাজ্যের রাজারা ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবেন, অথবা তারা স্বাধীনতা বজায় রেখে শাসনকাজ চালাতে পারবেন। ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর পাকিস্তান-সমর্থিত পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার বিদ্রোহী নাগরিক এবং পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পশতুন উপজাতিরা কাশ্মির রাজ্য আক্রমণ করে। এসময় কাশ্মিরের রাজা গভর্নর-জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে সহায়তা চান।
রাজা ভারতভুক্তির পক্ষে স্বাক্ষর করবেন এমন শর্তে মাউন্টব্যাটেন কাশ্মিরকে সাহায্য করতে রাজি হন। ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর হরি সিং কাশ্মিরের ভারতভুক্তির চুক্তিতে সই করেন। চুক্তি সই হওয়ার পর, ভারতীয় সেনা কাশ্মিরে প্রবেশ করে অনুপ্রবেশকারী পশতুনদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। বিষয়টি জাতিসংঘকের কাছে যায়। জাতিসংঘ ভারত-পাকিস্তানকে কাশ্মির থেকে সরে গিয়ে তাদের অধীনে গণভোটে আয়োজনের প্রস্তাব দেয়। ভারত প্রথমে এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫২ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচিত গণপরিষদ ভারতভুক্তির পক্ষে ভোট দিলে ভারত গণভোটের বিপক্ষে মত দেয়। কারণ, এটা অনেকখানি নিশ্চিত ছিল যে গণভোটে মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মিরের বেশিরভাগ ভোটারই পাকিস্তানের পক্ষে ভোটদান করবে। এতে কাশ্মিরে ‘ভারত ত্যাগ’ আন্দোলন জোরালো হওয়ার শঙ্কা ছিল। ভারত বেশ কিছু যুক্তি দেখিয়ে গণভোটে অসম্মত হওয়ায় পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহারে অসম্মত হয়। সেই থেকে যে যেভাবে পেরেছে কাশ্মিরের দখল বজায় রেখেছে। তবে, বড় অংশই আছে ভারতের নিয়ন্ত্রণে।
মুসলিম প্রধান কাশ্মির ও গুজরাট রাজ্যের কচ্ছ মরু অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে কাশ্মিরের কার্গিলে আবার যুদ্ধে লিপ্ত হয় এ দুই দেশ। কাশ্মিরে নিয়ে দু’দেশের মধ্যে মাঝে মাঝেই উত্তেজনা ছড়ায়। পাশপাশি, কাশ্মিরের ভেতরকার দ্বন্দ্ব তো আছেই। তবে, সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মত জানতে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের গণভোটের আয়োজন হয়নি।
Leave a reply