ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে স্কুলশিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানের শিক্ষা অধিকার আন্দোলনকারী মালালা ইউসুফজায়ী।
শনিবার একাধিক টুইটে তিনি বলেন, কাশ্মীরের শিক্ষার্থীরা যাতে নিরাপদে আবার স্কুলে ফিরতে পারে সে বিষয়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যেন আলোচনা হয়। খবর দ্যা ডনের।
৫ আগস্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর থেকে নিরাপত্তার অভাবে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠাচ্ছেন না।
আগস্টের মাঝামাঝি স্কুল খুললেও দফায় দফায় কারফিউতে উপত্যকার অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই হাজির হতে পারছে না।
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের মধ্য দিয়ে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ও বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয় বিজেপি নেতৃত্বাধীন দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার।
লাদাখ ও কাশ্মীরকে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করতে পার্লামেন্টে বিল পাস হয়। এই পদক্ষেপ কেন্দ্র করে কাশ্মীরজুড়ে মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক অতিরিক্ত সেনা। জারি করা হয়েছে বিধিনিষেধ।
সড়কগুলোতে গড়ে তোলা হয় কাঁটাতারের ব্যারিকেড। টেলিফোন, মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকায় অনেকেই নিজেদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। ৩৯ দিন পর তুলে নেয়া হয় নিষেধাজ্ঞা।
স্কুলগুলো খুলে দেয়া হলেও ভয়ে স্কুলে যাচ্ছে না শিশুরা। এ কারণে প্রাইভেট শিক্ষকদের দ্বারস্থ হচ্ছেন অভিভাবকরা।
কাশ্মীরি যুবক মুনাজা বলেন, আমি আগে থেকেই চাচাতো ভাইবোনদের পড়াতাম। গত কয়েক দিন ধরে বহু অভিভাবক এসে অনুরোধ করছেন তাদের বাড়ি গিয়ে পড়ানোর জন্য।
আসলে পরীক্ষার সময় গেলেও ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো উচিত হবে কিনা, তা নিয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারছেন না বাবা-মায়েরা।
২০১৬ সালের জুলাইয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে হিজবুল জঙ্গি বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পরও উত্তাল হয়েছিল উপত্যকা। সেই সময়ে লাগাতার অশান্তি ও কারফিউর জেরে প্রায় তিন মাস বন্ধ ছিল স্কুল-কলেজ।
অভিভাবকরা জানাচ্ছেন, বেশিরভাগ স্কুলের পরীক্ষা শুরু হয় সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। তাই অনেক দিন স্কুল বন্ধ থাকলেও ছেলেমেয়েদের পরীক্ষায় বসতে যাতে অসুবিধা না হয়, সেদিকে নজর রাখছেন তারা। এ বছরে এখনও পর্যন্ত পরীক্ষার ফরম দেয়া হয়নি কাশ্মীরের কোনো স্কুলে।
পরীক্ষা ছাড়াই সরকার সব ছাত্রছাত্রীকে পরের ক্লাসে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে।
আগেও ২০০৮, ২০১০ ও ২০১৬ সালে একইভাবে পরীক্ষা না নিয়ে পরের ক্লাসে তুলে দেয়া হয় সব শিক্ষার্থীকে।
নওগাঁমের বাসিন্দা আসিফা জানান, গত মাস থেকেই বাচ্চাদের বাড়িতে পড়াচ্ছেন তিনি। তার মতে, স্কুলে না যাওয়ার যে ক্ষতি, তা অনেকটাই সামলানো যাবে এতে।
ওই গৃহবধূর বক্তব্য, ৫ আগস্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর থেকে স্কুল কেন বন্ধ হয়ে গেল, তা বোঝানো যাচ্ছে না ছোটদের।
তিনি বলেন, আমি নিজের বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করতেই আত্মীয়, প্রতিবেশীরা তাদের ছেলেমেয়েদের পাঠাতে শুরু করেছেন। যদিও এভাবে স্কুলের অভাব মেটানো সম্ভব নয়, তবে দিনের কিছুটা সময়ে ওদের ব্যস্ত রাখা যায়।
এর আগে কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’ বাতিল করে এলাকাটিকে দুটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার কয়েক দিনের মাথায় মালালা টুইটার পোস্টের মাধ্যমে নিজের অবস্থান জানিয়েছিলেন।
সেই সময় তিনি কাশ্মীর সংঘাতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট টেনে টুইটারে লেখেন, ‘যখন আমি শিশু ছিলাম, যখন আমার মা-বাবা শিশু ছিল, এমনকি যখন আমার দাদা-দাদি তরুণ ছিল, তখন থেকেই কাশ্মীরের জনগণ বসবাস করছে সহিংসতার মধ্যে।
বিগত সাত দশক ধরে কাশ্মীরের শিশুরা বেড়ে উঠছে মাত্রাতিরিক্ত সহিংসতার মধ্যে। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পর এক টুইটে মালালা বলেন, ‘আমি আটককৃত ৪ হাজার কাশ্মীরি নিয়ে উদ্বিগ্ন, যাদের মধ্যে শিশুও রয়েছে। অনেকে ৪০ দিনেরও বেশি সময় ধরে স্কুলে যায়নি। অনেক মেয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছে না।
বিশ্বনেতাদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আমি জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন সামনে রেখে নেতাদের বলতে চাই- আপনারা কাশ্মীরিদের আওয়াজ শুনুন, সেখানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ করুন এবং শিশুরা যেন নিরাপদে স্কুলে ফিরতে পারে সেই সহায়তা করুন।
কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মালালা বলেন, তিনি তিনজন কাশ্মীরি কিশোরীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম ছিল। কাশ্মীর একদম নিশ্চুপ। কার সঙ্গে কী হচ্ছে বোঝার কোনো উপায় নেই। পরিস্থিতি সত্যিই অনেক ভয়াবহ।
২০১২ সালে নারী শিক্ষা নিয়ে সরব মালালার স্কুলবাসে উঠে একদল বন্দুকধারী তাকে গুলি করলে এ কিশোরী গুরুতর আহত হন।
এ ঘটনা তাকে বিশ্বজুড়ে নারী শিক্ষা ও মানবাধিকার কর্মীদের অনুপ্রেরণার প্রতীকে পরিণত করে। কাশ্মীর ইস্যুতে টুইটার পোস্টে মালালা আরও লিখেছেন, ‘ভোগান্তি চলমান রাখা আর একে অপরকে আঘাত করার কোনো দরকার নেই আমাদের।
আজকে আমি চিন্তিত কাশ্মীরের নারী আর শিশুদের নিয়ে, কোনো সহিংসতার ক্ষেত্রে যারা সব থেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে এবং সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আশা রাখছি, দক্ষিণ এশিয়ার সব মানুষ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের ভোগান্তির অবসানে তৎপর হবে।
সূত্র: যুগান্তর
Leave a reply