জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রকল্পের টাকা থেকে চাঁদা দাবি সহ বিভিন্ন অভিযোগ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সেক্রেটারির পদচ্যুতির পর এবার ঘটনায় নতুন মোড় নিচ্ছে। গতকাল সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস হয় পদচ্যুত সেক্রেটারি গোলাম রাব্বানীর সাথে জাবি ছাত্রলীগের এক নেতার ফোনালাপ।
কারা কিভাবে কত টাকা পেয়েছে তাও উঠে এসেছে তাদের কথোপকথনে। তবে ছাত্রলীগকে চাঁদা দেয়া এবং এর সঙ্গে পরিবারের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছেন জাবি ভিসি। অডিওর কথাবার্তা মিথ্যা, রাব্বানী পদ হারিয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সূত্র মতে, ৯ আগস্ট যে চারজন ভিসির বাসায় ‘টাকা বাটোয়ারা’র জন্য গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে সাদ্দাম হোসেনও ছিলেন।
অডিও শুনে বোঝা যায়, শাখা ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি হামজা রহমান অন্তর রাব্বানীকে ফোন দেন। ফোন রিসিভ করে রাব্বানী বলেন, হ্যালো অন্তর, টাকা নেয়ার সময় কে কে ছিল? তখন অন্তর বলেন, জুয়েল (শাখা সভাপতি), চঞ্চল (সাধারণ সম্পাদক), সাদ্দাম (যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক)।
টাকাটা কোথায় বসে দিয়েছে- রাব্বানী জানতে চাইলে অন্তর বলেন, ভিসি ম্যামের বাসায়। অন্তর তখন বলেন, সাদ্দাম ভাই আমার পাশে আছে, কথা বলবে? রাব্বানী সম্মতি দিলে কথা বলা শুরু করেন সাদ্দাম।
তাদের কথোপকথনের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হল-
রাব্বানী : কি খবর ভাই?
সাদ্দাম : ভাই খবর তো আমি জানাইছি, খবর তো ভালো না বেশি একটা। আমি তো আপনাকে জানাইছি ভাই আমি, তাজ (নিয়ামুল হাসান তাজ-সহসভাপতি), জুয়েল ও চঞ্চল- এ চারজন ছিলাম ভাই ওই মিটিংয়ের সময় (টাকা নেয়ার সময় ভিসির বাসায়)।
রাব্বানী : ম্যাম তো বলছে এ আন্দোলনও নাকি আমরা করাইছি! আন্দোলন কারা করছে সেটাও তো আমরা জানি না।
সাদ্দাম : বিষয়টা হচ্ছে, উনি ছাত্রলীগের ওপর সবকিছু দিয়া নিজের ফ্যামিলিরে সেভ করতে চাচ্ছে।
রাব্বানী : আচ্ছা, যখন টাকাটা দিছে তখন তুই ছিলি না?
সাদ্দাম : হ্যাঁ, ভাই, আমি ছিলাম।
রাব্বানী : টাকাটা দিছে কিভাবে? ম্যাম নিজেই দিছে, অন্য কেউ ছিল না?
সাদ্দাম : ওখানে হচ্ছে, ভাই, আর কেউই ছিল না। ম্যাম এবং তার পরিবার হচ্ছে, আমাদের সঙ্গে ডিলিংসটা করছে। পরে সে হচ্ছে টাকাটা আমাদের হলে পৌঁছে দিছে।
রাব্বানী : হলে পৌঁছে দিছে টাকা?
সাদ্দাম : হ্যাঁ, হ্যাঁ, একটা গাড়িতে করে এক লোক এসে দিয়ে গেছে।
রাব্বানী : কয় টাকা দিছে?
সাদ্দাম : আমাদের বলছে, এক কোটি। আমরা বাকিটা জানি না। জুয়েল আর চঞ্চলের সঙ্গে আলাদা সিটিং হইতে পারে।
রাব্বানী : আমি শুনলাম, এক কোটি ষাট।
সাদ্দাম : ওইটা ভাই, ষাটেরটা আমরা জানি না। উনি এক কোটি ভাগ করে দিছে। পঞ্চাশ হচ্ছে জুয়েলের, পঁচিশ আমাদের আর পঁচিশ চঞ্চলের।
রাব্বানী : ও, ম্যাডাম এভাবে ভাগ করে দিছে? জুয়েল ভালো ছেলে এজন্য পঞ্চাশ আর চঞ্চল ক্যাম্পাসের বাইরে থাকে এজন্য পঁচিশ?
সাদ্দাম : হ্যাঁ। চঞ্চল আমাদের তো বাদ দিতে পারে নাই। ঝামেলা এড়ানোর জন্য বা…
রাব্বানী : ও, চঞ্চলের ভাগেরটাই তোরা পাইছস?
সাদ্দাম : হ্যাঁ, চঞ্চলের ওখান থেকেই। আমরা বলছি যে, ২৫ পার্সেন্ট আমাদের দেয়া লাগবে। তারা হচ্ছে ভাই, তাহলে আমাদেরকে না জানায়া তাদেরকে আলাদা ষাট লাখ টাকা দিছে, এটা হইতে পারে।
রাব্বানী : ও, তাহলে তোদেরকে না জানায়া দিছে?
সাদ্দাম : হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা এটা জানি না। আমরা এক কোটির হিসাব জানি।
রাব্বানী : তোমার ম্যাডাম যে আমাদের নাম জড়াইলো এখানে, টাকার ব্যাপারে আমার বা শোভনের কোনো আইডিয়াই তো নাই।
সাদ্দাম : ভাই, উনি খুব নোংরামি করতেছে।
রাব্বানী : আমিও বুঝতেছি। নিজে সেভ হওয়ার জন্য, ফ্যামিলি সেভ করার জন্য। এ ছয়টা কাজ বেসিক্যালি ঠিকাদারদের সঙ্গে ডিল করছে কে?
সাদ্দাম : ভাই, মূলত ডিলটিল করছে তার ছেলে, তার পিএস সানোয়ার ভাই, পিডি আর তার স্বামী- এ চারজন।
রাব্বানী : হাজবেন্ড, ছেলে, পিডি (প্রকল্প পরিচালক) নাসির আর পিএস (ভিসির একান্ত সচিব) সানোয়ার? ও তারা আগে থেকে ছয়টা কোম্পানি ঠিক করে রেখেছে?
সাদ্দাম : হ্যাঁ, শুরু থেকেই তারা সব কিছু করছে।
রাব্বানী : টেকনিক্যাল কমিটিতেও ভিসি ছিল? ভিসি তো থাকতে পারে না।
সাদ্দাম : হ্যাঁ, সে ছিল। প্রথমত সে তো সবাইরে ফেরত-টেরত পাঠায়া দিল না! সিডিউল ছিনায়া-টিনায়া নিছিল। পরে হচ্ছে, আমরা বলছি, সবাইরে কিনতে দিতে হবে, সবাইরেই ড্রপ করতে দিতে হবে। তখন হচ্ছে, ড্রপ সবাইরেই করাইছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে, নিজ হাতে সব বিষয়গুলা করছে।
পরে আবার কথা বলবেন বলে রাব্বানী ফোনালাপ শেষ করেন।
যুগান্তরের হাতে আসা এ অডিওটি রাব্বানীর সঙ্গে নিজের কথোপকথন বলে নিশ্চিত করেছেন সাদ্দাম। তবে কবে কথা বলেছে সেটি বলতে না পারলেও হামজা রহমান অন্তরের ফোনে কথা বলেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি।
শাখা ছাত্রলীগের এক কোটি টাকা পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রোববার রাতে মুঠোফোনে সাদ্দাম বলেন, ‘সেটি আমার সঠিক মনে পড়ছে না। টাকা নেয়ার বিষয়টি মনে করে তারপর নিশ্চিত করব।’
রাব্বানীর সঙ্গে অনেক কথা হতো উল্লেখ করে সাদ্দাম বলেন, ‘ভাই (রাব্বানী) যেভাবে বলেছে আমরা সেভাবে বলেছি। তার কথামতো করেছি।’ এর কিছুক্ষণ পর সাদ্দাম এ প্রতিবেদকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘টাকা পেয়েছি কিনা সে বিষয়ে আমি মন্তব্য করব না। তবে ১০ তারিখের (সেপ্টেম্বর) দুপুরের পরের আমার ফোন কল বের করলেই সব ক্লিয়ার হবে।’
এ বিষয়ে জানতে রোববার রাতে জাবি ভিসিকে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি অডিওর তথ্যগুলো সঠিক নয় বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, রাব্বানী আমার বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র করছে। অডিওতে অর্থ ভাগবাটোয়ারার যে তথ্য দিয়েছে সেটা বানোয়াট।
আমার পরিবারের যে সংশ্লিষ্টতা দেখানো হয়েছে তাও পুরোপুরি মিথ্যা। রাব্বানী পদ হারিয়ে আমাকে এখন ফাঁসানোর চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এদিকে অডিও শুনে কয়েকজন শিক্ষক বলেছেন, এটি ভিসিকে ফাঁসানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে ফাঁস করা হয়েছে।
(সূত্র: যুগান্তর)
Leave a reply