সৌদি আরব ও ইরান। মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী দুই প্রতিবেশী দেশ। কিন্তু তাদের মধ্যে দশকের পর দশক ধরে চলছে দ্বন্দ্ব। বলা যায় একে অপরের জানের শত্রু। সম্প্রতি সেই দ্বন্দ্ব আরও কঠিন আকার নিয়েছে। চলতি সপ্তাহে সৌদির দুটি তেল স্থাপনায় ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীর ড্রোন হামলার পর দুই পক্ষ একেবারে মুখোমুখি অবস্থানে। কিন্তু মুসলিম প্রধান এই দেশ দুটির মধ্যে কেন এই দ্বন্দ্ব-শত্রুতা?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দ্বন্দ্বের পেছনে কাজ করছে মধ্যপ্রাচ্যে দেশ দুটির আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের রাজনীতি। জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের পার্থক্য সেই দ্বন্দ্বকে আরও উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলেছে। বহুদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো মুসলিম বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করে আসছে সৌদি। কিন্তু বর্তমানে রিয়াদ মনে করছে, মধ্যপ্রাচ্যে তেহরানের প্রভাব বাড়ছে। বাড়ছে গুরুত্ব। আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের দ্বন্দ্ব থেকে ইরানকে হুমকি ভাবছে সৌদি আরব। সৌদি আরব ও ইরান দুই দেশেরই ধর্ম ইসলাম। কিন্তু ইরান প্রধানত শিয়াপন্থী। আর সৌদি সুন্নিপন্থী এবং নিজেকে সুন্নি দেশগুলোর নেতা মনে করে। দুই দেশের মধ্যে জাতিগত বিভক্তিও রয়েছে। সৌদিরা আরব, আর ইরানিরা পার্সি জাতি। এছাড়া উভয়ের মধ্যে শাসনতান্ত্রিক পার্থক্যও বিদ্যমান। ইরান মূলত ইসলামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আর সৌদি একনায়ক রাজতান্ত্রিক। মধ্যপ্রাচ্যের দেশের সবগুলোতেই এই শিয়া-সুন্নি ভেদ দেখা যায়। সুন্নি দেশগুলো সবক্ষেত্রে সৌদিমুখী আর শিয়াপ্রধান দেশগুলো ইরানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ইসলামের উৎপত্তিস্থল হিসেবে সৌদি ঐতিহাসিকভাবেই নিজেকে মুসলিম বিশ্বের মোড়ল হিসেবে দেখে থাকে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে সেই মোড়লপনা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। আগে সম্পর্ক ভালো থাকলেও ইরান বিপ্লবের পর তেহরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হয়। সেই সুযোগে মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে ওঠে রিয়াদ। ইরানের প্রভাব ঠেকাতে বিশ্বজুড়ে সুন্নিদের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা চালায় সৌদি আরব। শিয়া প্রভাব মোকাবিলায় সৌদি আরব ওয়াহাবি আদর্শের বিস্তারেও তৎপর হয়।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এসে ইরান ও সৌদি আরবের সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। তবে তাদের মধ্যে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেই যায়। গত কয়েক দশকে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতির কাঠামোতে বড় পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে বেশ কয়েকটি ঘটন-অঘটনের কারণে সৌদি ও ইরানের মতপার্থক্য আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনে সুন্নিপ্রধান দেশ ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পতন ঘটে। ৮০-র দশকে ইরানের বিরুদ্ধে প্রায় এক দশক ধরে যুদ্ধ করা সাদ্দাম হোসেনের পতনে তেহরানের পাল্লা ভারি হতে থাকে। বাগদাদে ইরান সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠার দ্বার খুলে যায়। সেই সঙ্গে দেশটিতে তেহরানের প্রভাব বিস্তার লাভ করে।
সর্বশেষ ২০১১ সালে আরব বসন্তে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যের কাঠামো ভেঙে পড়েছে। নতুন করে প্রভাব বিস্তারের খেলায় মাতে রিয়াদ ও তেহরান। বিশেষ করে সিরিয়া, ইয়েমেন ও বাহরাইনে প্রতিপত্তির প্রতিষ্ঠায় মরণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উভয়পক্ষই। সিরিয়া ও ইয়েমেনে চলা সংঘাতে সৌদি আরব ও ইরানের অবস্থান বিপরীতমুখী। উভয় দেশই তাদের প্রভাব বলয় বাড়াতে তৎপর। এই দুই দেশে ইরান-সমর্থিতরা জয়ী হলে তা সৌদি আরবের জন্য সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক হুমকি সৃষ্টি করবে বলে রিয়াদের শঙ্কা।
Leave a reply