গণপূর্ত অধিদফতরের ৩টি প্রকল্পের সম্পন্ন কাজের চেয়ে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা বেশি বিল তুলে নিয়েছেন র্যাবের হাতে গ্রেফতার ‘টেন্ডারসম্রাট’খ্যাত যুবলীগ নেতা জি কে শামীম। অধিদফতরের নিজস্ব এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
যে কাজ করা হয়নি তার বিল কীভাবে তুলে নেয়া হল এবং কারাই বা এ বিল দিতে সহায়তা করল- তার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন গণপূর্ত অধিদফতরের অনেক প্রকৌশলী।
এদিকে দরপত্রের শর্ত ভেঙে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখার কারণে বাতিল হতে পারে এই তিনটি প্রকল্পসহ জি কে শামীমের চলমান ১২ প্রকল্পের কার্যাদেশ। শিগগিরই এ বিষয়ে জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানিকে নোটিশ করবে গণপূর্ত অধিদফতর।
সব মিলে কার্যাদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে ২ থেকে ৩ মাস সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গণপূর্ত অধিদফতরের সম্প্রতি করা ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানির হাতে থাকা আগারগাঁও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্মাণাধীন ভবনের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৩০ শতাংশ।
কিন্তু বিল পরিশোধ করা হয়েছে ৯৩ দশমিক ২৯ শতাংশের। সে হিসেবে এ প্রকল্পে ২০১ কোটি ৯০ লাখ টাকা বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। র্যাব হেডকোয়ার্টারের কাজের অগ্রগতি ৭ শতাংশ।
কিন্তু বিল পরিশোধ করা হয়েছে ২৮ শতাংশের। এ প্রকল্পে ৯১ কোটি ৮১ লাখ টাকা বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। পঙ্গু হাসপাতালের নতুন ভবন নির্মাণের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৯৮ শতাংশ। কিন্তু বিল পরিশোধ করা হয়েছে ৯৯.৪২ শতাংশের। এক্ষেত্রে বেশি পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। তিন প্রকল্পে কাজের চেয়ে ২৯৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা বেশি বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
গণপূর্তের প্রকৌশলীদের দাবি, বর্তমান গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী অত্যন্ত সততার সঙ্গে সব কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এতে মন্ত্রণালয়সহ সব দফতর ও অধিদফতরের কার্যক্রমে স্বচ্ছ পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
জি কে শামীমের যেসব প্রকল্পে কাজ না করে বিল পরিশোধের ঘটনা ঘটেছে সেগুলো মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের আগের ঘটনা। এটা সম্পূর্ণভাবে অনিয়ম এবং অপরাধ। যারা এর সঙ্গে জড়িত তদন্ত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। নইলে গণপূর্তে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম বলেন, যদি এসব প্রকল্পের কোনোটির ক্ষেত্রে অগ্রিম বিল নেয়ার ঘটনা ঘটে থাকে সেক্ষেত্রে তার অন্য প্রকল্পের পাওনা থেকে সমন্বয় করা হবে। আর এসব অনিয়মের তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী শাহাদাত হোসেন বলেন, কাজ যতটুকু হয়, ততটুকুর বিল দেয়া হয়। আগে কাজ শেষ করতে হয়, তারপর বিল দেয়া হয়। কোনো কারণে যদি আগে বিল পরিশোধ করা হয় তবে তার অন্য প্রকল্পের পাওনার সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।
এদিকে দরপত্রের শর্ত ভেঙে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখার কারণে বাতিল হতে পারে কাজের অতিরিক্ত বিল তুলে নেয়া তিন প্রকল্পসহ জি কে শামীমের চলমান ১২ প্রকল্পের কার্যাদেশ। এসব প্রকল্প জি কে শামীমের জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডসহ সহযোগী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অধীনে চলমান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি দফতর বা বিভিন্ন সংস্থা থেকে কোনো উন্নয়ন কাজ বা ক্রয় সংক্রান্ত দরপত্রের কার্যাদেশের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন শর্ত দেয়া হয়ে থাকে। তবে কিছু শর্ত আছে সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য থাকে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- কাজ বন্ধ রাখা যাবে না, নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু ও শেষ করা, মানসম্মত উপকরণ ব্যবহার করা।
কিন্তু জি কে শামীম গ্রেফতার এবং তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ হওয়ার পর থেকে এ ১২টি প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, শিগগিরই তার ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে এসব প্রকল্পের কাজ চালিয়ে নেয়া জি কে শামীমের পক্ষে সম্ভব হবে না। আর সেটা না হলে দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ হবে। তখন কার্যাদেশ বাতিল করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না গণপূর্ত অধিদফতরের।
এ প্রসঙ্গে জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা বলেন, জি কে শামীম গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আর এ কারণে নির্মাণাধীন প্রকল্পের কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। কবে চালু হবে বা চালু হবে কিনা সেসব কিছুই জানেন না এই প্রকৌশলী।
এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী শাহাদাত হোসেন বলেন, প্রকল্পগুলোর কাজ বন্ধ রয়েছে কিনা সে তথ্য আমার জানা নেই। কোনো কারণে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান শর্ত লঙ্ঘন করলে প্রথমে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হবে। এরপর ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
কবে নাগাদ এ ১২টি প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়ার পর তারা জবাব দেবে। এরপর সেই জবাব পর্যালোচনা করে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সব মিলে ২-৩ মাস সময় লাগতে পারে।
এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম বলেন, জি কে শামীমকে কোনো কাজ দেয়া হয়নি। কাজ দেয়া হয়েছে জি কে শামীমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে। সে কারণে ব্যক্তির সমস্যার অজুহাতে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখা চলবে না।
তিনি আরও বলেন, দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী কাজ বন্ধ রাখা যাবে না। কিন্তু জি কে শামীমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কাজগুলো তিনি গ্রেফতারের পর থেকে বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে জি কে শামীমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান জিকেবিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হবে।
এরপর তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেসব কাজ অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে করানো হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে ১২টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে, সেগুলো আমি দায়িত্ব নেয়ার আগের ঘটনা। এসব কাজের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গণপূর্ত অধিদফতরের ঠিকাদার জি কে শামীমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ৩৭টি দরপত্রে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার কাজ পায়। এর মধ্যে প্রায় ১,৬০০ কোটি টাকার ২৫টি প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ। তবে বেশির ভাগ প্রকল্পই হস্তান্তর হয়নি। আর চলমান ১২টি প্রকল্পের ১,৭০২ কোটি টাকার কাজ রয়েছে। র্যাবের অভিযানে জি কে শামীম গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে এসব প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে।
১২টি প্রকল্প হল- ৪৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন র্যাব হেডকোয়ার্টার্স নির্মাণ। এর অগ্রগতি ৭ শতাংশ। এতে জিকেবির ৫টি কন্সট্রাকশন পার্টনার থাকলেও তারাও গা ঢাকা দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জে প্রায় ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৭২টি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরুই হয়নি।
এতেও জিকেবির ৩টি কন্সট্রাকশন পার্টনার রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের খানপুরে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩শ’ বেড হাসপাতালকে ৫শ’ বেডে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ১৩ শতাংশ। এ প্রকল্পে জিকেবি ছাড়াও আরও ৩টি প্রতিষ্ঠান সহযোগী হিসেবে রয়েছে।
মিরপুর সেকশন-৬ এ সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ৭৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয়ে ১ হাজার ৬৪ ফ্ল্যাট নির্মাণের অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। জিকেবি ছাড়া এ প্রকল্পে আরও ৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ৩১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ভবনের মাত্র ৩০ শতাংশের কাজ শেষ হয়েছে।
এখানে জিকেবির সহযোগী প্রতিষ্ঠান তিনটি। ১০২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে পঙ্গু হাসপাতালের নির্মাণাধীন ভবনের কাজের অগ্রগতি ৯৮ শতাংশ। এখানে জিকেবির সহযোগী প্রতিষ্ঠান ১টি। আগারগাঁও নিউসায়েন্স হাসপাতালের ১৬৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন বহুতলা ভবনের ১৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
এখানে জিকেবির সহযোগী প্রতিষ্ঠান দুটি। ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ভবন নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ। এ প্রকল্পে জিকেবির সহযোগী প্রতিষ্ঠান দুটি। প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে আগারগাঁওয়ে নির্মাণাধীন এনজিও ফাউন্ডেশন ভবনের কাজের অগ্রগতি ১ শতাংশ। এখানে জিকেবির সহযোগী প্রতিষ্ঠান একটি। ৩২৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে সচিবালয়ের ভেতরের ২০ তলা নতুন ভবন নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ৩ শতাংশ।
এখানে জিকেবির সহযোগী প্রতিষ্ঠান একটি। ৬২ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে সচিবালয়ের আরেকটি ভবন নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ৮০ ভাগ। এখানে জিকেবির সহযোগী প্রতিষ্ঠান ৩টি। আর ৫৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে বেইলি রোডের হিলট্যাক্স কমপ্লেক্সের অবকাঠামো তৈরির কাজ শেষ হলেও অন্যান্য কার্যক্রম শেষ হয়নি। সব প্রকল্পের কাজই এখন বন্ধ।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর।
Leave a reply