ইসমাইল হোসেন সম্রাট। যুবলীগের নাম করা নেতা। রাজধানীর জুয়ার আসরগুলোতে পরিচিত ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত। মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরাপুল, পল্টন এলকাসহ অন্তত ১০টি ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসায় সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তার। অন্ধকার দুনিয়া থেকে কামিয়েছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। শোনা যায়, চাঁদাবাজিতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামে নিয়মিত যাকাতের অর্থ ও অনুদান দেন সেখান থেকেও চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্রাটের বিরুদ্ধে! তবে, তার উত্থান কিন্তু একদিনে নয়। পিতার কর্মসূত্রে শৈশবে ঢাকায় চলে আসা সম্রাটের উত্থান রাজনীতির চোরাগলির মধ্য দিয়েই।
ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরীর জন্ম ফেনীর পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের পূর্ব সাহেবনগর গ্রামে। তার বাবা ফয়েজ আহমেদ ছিলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। বাড়ি পরশুরামে হলেও সেখানে তাদের পরিবারের কেউ থাকেন না। বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায় বড় হন সম্রাট।
সম্রাটের রাজনৈতিক জীবন শুরু ১৯৯০ সালে। সেই সময় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন তিনি। তখন সারাদেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল। রমনা অঞ্চলে আন্দোলনের সংগঠকের দায়িত্বে ছিলেন সম্রাট। আন্দোলনের কারণে জেলও খাটতে হয়।
এরাশাদ সরকার পতনের পর ক্ষমতায় আসে বিএনপি সরকার। সে আমলে সম্রাটের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। দলে একজন ত্যাগী কর্মী হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। এরপর ১৯৯৬ থেকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে যুবলীগে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন সম্রাট। ১/১১-এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সময় সম্রাট যুবলীগের পরিচিত মুখ ছিলেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসে। এরপর থেকেই রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হতে থাকেন সম্রাট। আওয়ামী লীগের বড় বড় অনুষ্ঠানে পরিচিত মুখ হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। দক্ষিণ যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা মিল্কীর হত্যাকাণ্ডের পর সম্রাটের আর পিছু তাকাতে হয়নি। মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইল, বাড্ডা এলাকার অপরাধ জগতে সম্রাটের একক আধিপত্য তৈরি হয়। কথিত আছে, ঢাকার এক সময়কার শীর্ষ সন্ত্রাসী, সম্প্রতি দুবাইয়ে আটক হওয়া জিসান আহমেদের সাথে মিলে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতেন সম্রাট।
যুবলীগের সবশেষ কাউন্সিলে তিনি যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি নির্বাচিত হন। সম্রাটের ঘনিষ্ঠ দুই সহচর হিসেবে পরিচিত ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ (কাউন্সিলর) ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। সাঈদকে কাউন্সিলর বানান সম্রাটই। পরে তাকে দিয়ে ক্যাসিনো ব্যবসা দেখভাল করাতেন সম্রাট। সাম্প্রতিক অভিযানে আটক হওয়া ঠিকাদার জিকে শামীমও সম্রাটের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সম্রাটকে অবৈধ আয়ের ভাগ দিতেন তিনি।
ঢাকায় ক্ষমতাসীন দলের অন্যতম সক্রিয় কর্মী ছিলেন সম্রাট। দলীয় সমাবেশগুলো সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন তিনি। টাকা ও জনবল সরবরাহের কাজ করতেন সম্রাট। দ্রুতই যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন সম্রাট। ওমর ফারুক চৌধুরী সম্রাটকে যুবলীগের শ্রেষ্ঠ সংগঠক ঘোষণা করেন। আর তার ইউনিটটিকে ঘোষণা করেন সেরা সাংগঠনিক ইউনিট হিসেবে।
যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের মতো একটি বড় ইউনিটের সভাপতি হওয়ার সুবাধে তার ছিল বিশাল বাহিনী। কাকরাইলের অফিসে অবস্থান করলেও কয়েকশ নেতাকর্মী সব সময় তাকে ঘিরে রাখতো সম্রাটকে। অফিস থেকে বের হয়ে কোথাও গেলে তাকে প্রটোকল দিতেন শতাধিক নেতাকর্মী। অবৈধ উপার্জনের টাকা দিয়েই এই বাহিনী পালতেন সম্রাট। টাকা ভাগ বাটোয়ারার ক্ষেত্রে বিশেষ সুনাম ছিলো সম্রাটের।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যুবলীগ নেতাদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যুবলীগের কয়েকজন নেতার কথা উল্লেখ করে বলেন, তারা শোভন-রাব্বানীর চেয়েও খারাপ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে। আরেকজন এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন। সদলবলে অস্ত্র নিয়ে ঘোরেন। এসব বন্ধ করতে হবে। যারা অস্ত্রবাজি করেন, যারা ক্যাডার পোষেণ, তারা সাবধান হয়ে যান, এসব বন্ধ করুন। তা না হলে যেভাবে জঙ্গি দমন করা হয়েছে, একইভাবে তাদেরও দমন করা হবে।
এরপরই অবৈধ ক্যাসিনো ও টেন্ডাবাজির বিরুদ্ধে অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একে একে গ্রেফতার করা হয় খালিদ মাহমুদ ভূঁইয়াসহ বেশ কয়েকজন যুবলীগ নেতাকে। গ্রেফতার হন জিকে শামীমের মতো টেন্ডারবাজও। সম্প্রতি দুবাইয়ে আটক হন ঢাকার এক সময়কার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমদ। তাকে দেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
খালিদ ও শামীম দুজনেই জিজ্ঞাসাবাদে অপকর্মের ভাগীদার হিসেবে সম্রাটের নাম উল্লেখ করেছেন বলে জানা গেছে। এরপরই গা ঢাকা দেন সম্রাট। আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কাছে ধর্না দেন তাকে যেন গ্রেফতার না করা হয়। তিনি শেষ সুযোগ হিসেবে দেশ ছাড়ার সুযোগ চাইছিলেন। শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার এড়াতে পারেননি।
রোববার ভোর ৫ টার দিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জুশ্রীপুর গ্রাম থেকে সম্রাটকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। এসময় সম্রাটের আরেক সহযোগী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতি এনামুল হক আরমানকেও গ্রেফতার করা হয়।
একদিনে, তিনি ‘সম্রাট’ হয়ে ওঠেননি। নিজে যেমন ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তেমনি সময়ে সময়ে তাকেও ব্যবহার করেছেন সমাজের নানা শ্রেণির প্রভাবশালীরা। সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ চোরাগলি বন্ধ না হলে বন্ধ হবে না ‘সম্রাট’ তৈরির কারখানা।
Leave a reply