মনোয়ার হোসেন জুয়েল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
চাঁপাইনবাবগঞ্জে মহানন্দা নদী দখল করে তৈরি করা হয়েছে বহুতল ভবন। বালি ভরাট করে তা বিক্রি করা হচ্ছে প্লট হিসেবে। দখল থেকে বাদ যায়নি নৌ চলাচলের খেয়াঘাটটি। মহানন্দা, পাগলা আর পুনর্ভবা নদীতে ১’শ ৪৭ জন অবৈধ দখলদারকে চিহ্নিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা তথ্য বাতায়নে নদীর জমি অবৈধ দখলকারী ১শ’৪৫ জনের নামের তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। প্রশাসনের নাকে ডগায় গত দুই বছর থেকে এমন অপকর্ম চললেও শুধু অবৈধ দখলদারদের তালিকা করেই হাত গুটিয়ে বসে আছে জেলা প্রশাসন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিসের পাশেই শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত খালঘাট। আর সেটি পার হলেই গোয়ালবাড়ী খেয়াঘাটের দুই পাশে চলছে নদী দখলের মহৌৎসব। নদী দখলের সীমানা এসে ঠেকেছে প্রায় মাঝ নদীতে। স্থানীয় ভূমি অফিসের হিসেবে গোয়ালবাড়ী খেয়াঘাট এলাকায় অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে ৪.৫৩ একর বা প্রায় ১৪ বিঘা জমি। এসব এলাকায় কিছুদিন আগেও চাষ করা হত মৌসুমী ফসল। জেলার তিন নদী মিলিয়ে গোটা জেলায় নদী পাড়ে অবৈধ দখলীয় জমির পরিমান দাঁড়িয়েছে প্রায় সোয় দুই’শ বিঘা বা ৭৪ একর।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানাগেছে, এসব অবৈধ দখলকারীর তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী এই সংখ্যা দুই’শ ছাড়িয়ে যাবে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বছর দুয়েক আগে এই জমিগুলো ছিল নদী আর তার পাশেই ছিল সুবিশাল আম বাগান। অথচ ভুমিদস্যু একটি চক্র জাল কাগজ-পত্র করে তা নিজেদের দখলে নিয়েছে।
গোয়ালবাড়ী এলাকার গোলাম মোস্তফা জানান, যেখানে ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে সেখানে দুই বছর আগেও নদী ছিল। শুষ্ক মৌসুমে চর জেগে উঠার সুযোগে বালি ভরাট করে দখল করে বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে।
মহানন্দা নদীর মাঝি নন্দলাল জানান, আমার জন্মস্থান এখানেই, এই নদীতেই আমি ছোট থেকে নৌকা চালায়। এখন যেসব বাড়ি দেখছেন সেখানে ছিল নদী। যারা এখানে বিল্ডিং বানিয়েছে তারা নদীর পাড়ের কিছু জমি কিনে নিয়ে তারপর আস্তে আস্তে বালুদিয়ে ভরাট করে দখল করে নিয়েছে। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে সেটি চলে গেছে মাঝ নদী বরাবর।
ফিরোজ আলী, তোবজুল হোসেন, সাইদুর রহমান, কৃষক নারায়ণ মন্ডলসহ স্থানীয়রা যমুনা নিউজকে জানান, গোয়ালবাড়ি খেয়াঘাটি দখল করে নিয়েছে। জেলা পরিষদের কিছু লোকজনের সাথে যোগসাজস করে কয়েকজন শ্রমিক নেতা ঘাটের উপর পাঁকা দোকানঘরও বানিয়েছে। শুধু তাই নয়, এসব জায়গায় আরসিসি পিলার দিয়ে বালু ভারাট করে এখন প্লট আকারে বিক্রিও শুরু হয়েছে।
তারা আরো জানান,পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন এসব উচ্ছেদের জন্য এখানে এসেছিল কিন্তু তারপর কি কারণে উচ্ছেদ অভিযান হয়নি তা আমরা বলতে পারব না।
বেতবাড়িয়া মৌজায় নদী দখলের হোতা হিসেবে পরিচিত মহন্ত হালদার প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে তিনি দাবি করেন, এসব জমি তিনি কিনে নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করছেন। বাড়ি নির্মানে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের অনুমতি নিয়েছেন কিনা জানাতে চাইলে তিনি যমুনা নিউজকে জানান, বাড়ি তৈরি করতে অনুমতি নিতে হয় এমন বিষয় তার জানা নেই। তাছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের কেউ কিছু বলেওনি বা কখন বাঁধাও দেয়নি।
বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা রমজান আলী জানান, আমরা তাদের নোটিশ দিয়েছিলাম, কিন্তু তারা আরএস খাতিয়ান দেখিয়েছে আর অন্য কোন কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেনি। সে অনুযায়ী আমারা নদী অবৈধ দখলদারদের একটি তালিকা তৈরি করে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জমা দিয়েছি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ সাহিদুল আলম নদী দখলের সত্যতা স্বীকার করে জানান, অবৈধভাবে নদী দখল করে নদী প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এখন ভরাট করে প্লট আকারেও বিক্রি করা হচ্ছে, এসব আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ আমাদের এখতিয়ার না। আমরা অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। তারা উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করলে আমরা তাদের সহায়তা করব।
জেলা প্রশাসক এজেডএম নুরুল হক জানান, সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে মহানন্দা, পাগলা আর পুনর্ভবা নদীতে অবৈধ দখলদার রয়েছে। তারা নদীর বড় একটা অংশ দখল করে নিয়েছে সুতরাং সরকারী অফিসের কেউ না কেউ তো এসব অপকর্মে জড়িত আছে, এটি সত্য। আমরা যদি অস্বীকার করি তাহলে তা সত্যের অপআলাপ হবে। তবে জড়িতের চিহ্নিত করে আমরা তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করব। আর এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আমরা দ্রুত সাঁড়াশি অভিযান চালাব, কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার যমুনা নিউজকে জানান, নদী রক্ষায় আমাদের অনেক উদাসীনতা আছে। গত এক বছরে মানুষের অনেক অনাস্থা তৈরি হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নদী সংরক্ষণ ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। সুতারাং পানি আইন অনুযায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা মৌসুমে হাইটাইড এলাকা নির্ধারণ করেছে। সেখান থেকে ৫০ গজ এলাকার মধ্যে কেউ কোন স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারবেনা। এছাড়া আধুনিক হাইড্রোমারফলোজিক্যাল স্টাডির মাধ্যমে আমরা নদীর গতিপথ বা পূর্ববর্তী ইতিহাস বের করব। এখানে অনেক ঘাটতি আছে, অনেক উদাসিনতা আছে।
Leave a reply