নানা সংকট ও জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। অনিয়ম-দুর্নীতি, নিয়োগ ও উন্নয়ন কাজে ঘুষ লেনদেনসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। এর প্রতিবাদে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলছে।
এসব আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ ভিসির বিপক্ষের একটি গ্রুপ। আর আন্দোলন দমাতে ভিসির পক্ষ হয়ে সক্রিয় আছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আরেকটি গ্রুপ।
এছাড়া বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। যে কোনো সময় এই ক্ষোভ প্রকাশ্য রূপ নিতে পারে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
পাশাপাশি সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন- ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরেও দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
বিদ্যমান অস্থিরতার কারণে ইতিমধ্যে ৪৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ৩টি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্দোলনের মুখে সর্বশেষ মঙ্গলবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এর আগে ২ নভেম্বর দুই দল ছাত্রের সংঘর্ষের কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)। ছাত্রলীগের পিটুনিতে ৭ অক্টোবর ছাত্র আবরার ফাহাদ খুন হওয়ার ঘটনায় এক রকম স্থবির হয়ে আছে বুয়েট। ছাত্রছাত্রীরা ঘোষণা দিয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে রেখেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার মূলে দুটি কারণ।
একটি হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের নিয়োগ; অপরটি অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প। দুটির নেপথ্যেই আছে আর্থিক কর্মকাণ্ড। এই দুটি বিষয়ই যদি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরিয়ে দেয়া হয় তাহলে হয়তো এ ধরনের আর কোনো সংকট তৈরি হবে না।
আর সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যমান সংকটের সমাধান নিজেদেরই করতে হবে। তাদের স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। নিজেদের সিনেট-সিন্ডিকেট আছে।
সেখানে আলাপ করেই সমাধান বের করতে হবে। সরকার বা ইউজিসি এক্ষেত্রে কেবল পরামর্শ দিতে পারে। তবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট উত্তরণে করণীয় নির্ধারণে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দৃশ্যমান কারণ যা-ই থাকুক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতার মূল কারণ শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতি ও দলাদলি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক শিক্ষক ও ছাত্রনেতারা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।
এছাড়া দ্বিতীয় দফায় ভিসি নিয়োগকেও অনেকে অস্থিরতার কারণ হিসেবে দেখছেন। তবে যে কারণেই আন্দোলন হোক না কেন, এর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। এতে অনিয়মিত হয়ে পড়েছে ক্লাস ও পরীক্ষা। সেশনজটে নষ্ট হচ্ছে শিক্ষাজীবনের মূল্যবান সময়।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি, পদে বসার মানসিকতাসহ অন্যান্য কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা তৈরির ইতিহাস পুরনো। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সৃষ্ট অসন্তোষের মূলে আছে অনিয়ম-দুর্নীতি।
প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছেন। ওই নীতি যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় সময়ের জন্যই অস্থিরতা দূর হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পাঁচটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনটিতেই বর্তমানে অস্থিরতা চলছে। এর মধ্যে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ কেলেঙ্কারির ইস্যুতে গড়ে ওঠা শিক্ষক-শিক্ষার্থী আন্দোলনের মুখে মঙ্গলবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তুলনামূলক শান্ত আছে। কিন্তু বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি বিরাজ করছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। নীতিমালা লঙ্ঘন করে নিয়োগের ইস্যুতে ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে আছেন।
দিন দিন তা বড় আকার ধারণ করছে। এছাড়া একই বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে প্রভাষক পদে চাকরি না পাওয়া স্বর্ণপদকধারী নুরুল হুদা নামের এক ছাত্রের স্ত্রীর সঙ্গে প্রোভিসি চৌধুরী মো. জাকারিয়ার টাকা-পয়সা লেনদেন সংক্রান্ত ফোনালাপও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
এ নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। যদিও প্রোভিসি ওই ফোনালাপকে বানোয়াট হিসেবে দাবি করেছেন।
৭ অক্টোবর থেকে স্থবির হয়ে আছে বুয়েট। শিক্ষার্থীরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, পুলিশ তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিট না দেয়া পর্যন্ত তারা ক্লাস, পরীক্ষাসহ কোনো ধরনের একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নেবেন না।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চলছে। আর ২ নভেম্বর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে কুয়েটের একাডেমিক কার্যক্রম। দুই হলের ছাত্রদের মধ্যকার সংঘর্ষের জের ধরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেন।
কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হল ছেড়েছে ৭টি হলের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী। ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ করছে।
নিয়োগে ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগ সামনে এসেছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও (পাবিপ্রবি)। সেখানে ঘুষের বিনিময়ে এক প্রার্থীকে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার অডিও ভাইরাল হয়। এতে থাকা একটি কণ্ঠ খোদ ভিসি অধ্যাপক রোস্তম আলীর বলে দাবি করেছেন সমালোচকরা।
এছাড়া ভিসির বিরুদ্ধে নিয়মনীতি ভঙ্গ করে ২২ জনকে চাকরি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া ভিসি প্রশাসনিক ভবনের অবকাঠামো নির্মাণে ঠিকাদারদের কাছ থেকে অধিক হারে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করায় চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ঠিকাদার তা করছেন না বলে অভিযোগ দায়ের হয়েছে ইউজিসিতে।
এসব অভিযোগ তদন্ত চলছে। এসব অভিযোগ অবশ্য গণমাধ্যমে অস্বীকার করেছেন ভিসি ড. রোস্তম আলী।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধেও ইউজিসি অনুমোদন না করা সত্ত্বেও ৫ কোটি টাকায় ঢাকায় লিয়াজোঁ অফিসের নামে ফ্ল্যাট কেনার অভিযোগ উঠেছে। এর চেয়ে বড় অভিযোগ, নিজস্ব ফ্ল্যাট থাকার পরও ভাড়া কাটা হচ্ছে লিয়াজোঁ অফিসের নামে।
এছাড়া আছে বিনা টেন্ডারে ৫০ লাখ টাকার এসি কেনা ও নিয়োগ যোগ্যতা পূরণ না করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নিয়োগের অভিযোগ। ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এডহক ভিত্তিতে অসংখ্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এমনি নানা অভিযোগ জমা পড়েছে ইউজিসিতে। যুগান্তরের সঙ্গে এসব বিষয়ে আলাপকালে ভিসি অধ্যাপক ড. মতিয়ার রহমান হাওলাদার বলেন, তার আমলে কোনো অনিয়ম হয়নি।
ঢাকার বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ভিসির বিরুদ্ধেও উঠেছে নানা অনিয়ম ও গণনিয়োগের অভিযোগ। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ১০ কোটি টাকার এক প্রকল্প বাস্তবায়নে সাবেক ওই ভিসি ক্ষমতার অপব্যবহার করেন।
সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলকে পাশ কাটিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেন। ইতিমধ্যে ৫ কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগ ইউজিসি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা পড়েছে।
কিন্তু বিপত্তি ঘটেছে অন্যত্র। বর্তমান ভিসি ওই অভিযোগ তদন্তে যাতে মনোযোগ দিতে না পারেন সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল করার অভিযোগ উঠেছে ওই সাবেক ভিসির বিরুদ্ধে।
এ নিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। ভুয়া খবর প্রচারের অভিযোগে কয়েকদিন আগে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সভা করে সাবেক ভিসির কাছের এক কর্মকর্তাকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন।
জানতে চাইলে ভিসি অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম বলেন, সাবেক ভিসির ব্যাপারে দুদকে কে বা কারা অভিযোগ করেছে। তাতে প্রকল্পের বিষয়টি আছে।
ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ঢেউ লেগেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অর্থ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি করা হয়েছিল বলে দাবি করছে সংগঠনের একটি অংশ।
এরপর ওই কমিটি বাতিলের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে শাখা ছাত্রলীগের বড় একটি অংশ। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে কয়েক দফা ছোটখাটো সংঘর্ষও হয়েছে। পরিস্থিতি বড় আকার ধারণ করতে পারে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও একের পর এক নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন পদে নিয়োগ, পদায়ন ও আপগ্রেডেশনে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।
অবিশ্বাস্য গতিতে একইদিনে মৌখিক পরীক্ষার চিঠি ইস্যু, পরীক্ষা গ্রহণ এমনকি যোগদানের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এমনি নানা অনিয়ম-দুর্নীতির ইস্যুতে শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
অভিযোগ জমা পড়েছে ইউজিসিতে। সম্প্রতি আলাপকালে এ বিষয়ে ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আলাউদ্দিন বলেন, আমি কাজে যোগদানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতি ঘটেছে।
আর কিছু না পেয়ে কিছু লোক ইস্যু তৈরির চেষ্টা করছে। জানা গেছে, এভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েই অনিয়ম-দুর্নীতি, দলাদলি এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত। এসব ইস্যুতেই প্রতিপক্ষের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হচ্ছে ক্যাম্পাস।
সম্প্রতি খোদ ইউজিসি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, নানা ধরনের অভিযোগ ওঠায় বর্তমানে ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ব্যাপারে তদন্ত চলছে।
ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, শুধু এখন নয়, অতীতেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ব্যাপারে অভিযোগ এসেছে। সব অভিযোগ যে সঠিক তা নয়। অভিযোগ এলে আমরা তদন্ত করি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে সুপারিশ হয়। আমার হাত দিয়েই করা দুই তদন্তে দুই ভিসিকে অপসারণ করা হয়েছে। তাদের একজন গোপালগঞ্জ ও আরেকজন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি।
কিন্তু অভিযোগকে কেন্দ্র করে ছাত্র-শিক্ষকরা নিজ নিজ কাজ ফেলে কেন আন্দোলন করবেন। তারা আমাদের কাছে অভিযোগ দিয়ে তদন্ত করার সুযোগ দিতে পারেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ বজায় থাকে। সেশনজটে পড়তে হয় না।
আরএম
Leave a reply