গণপিটুনির হাত থেকে বেঁচে গেলেন যে নারী

|

অল্পের জন্য গণপিটুনীর হাত থেকে রক্ষা। ছবি- রাশেদ সুমন।

মনিরুল ইসলাম:

বাড্ডার তাসলিমা রানুর কথা মনে আছে নিশ্চয়। ছেলেধরা গুজবে মুহূর্তেই তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। সেরকম আরেকটা গণপিটুনির ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল ঢাকার অদূরেই, সাইনবোর্ড মোড়ে। হয়তো আমি বা আমার মতো কেউ বাধা না দিলে শ্রমিকদের মারধরে রানুর মতোই পরিণতি হতে পারতো এই নারীর।

বুধবার সকাল থেকে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবরোধ করে বাস-ট্রাক শ্রমিকরা। শুধু অবরোধ নয়, শুরু হয় তাদের নৈরাজ্য। স্কুল-কলেজের বাস-ভ্যান পর্যন্ত তাদের নৈরাজ্য থেকে বাদ যায়নি। রিপোর্টার হিসেবে সেই ঘটনা কাভার করতে গিয়েছিলাম। বেলা ১২টার নিউজে সরাসরি সম্প্রচারে যুক্ত থাকা অবস্থায়ই দেখলাম, একজন নারীকে শ’দুয়েক মারমুখী শ্রমিক ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় আড়াআড়ি করে রাখা দুই বাসের মাঝখানে নারীটিকে ঠেলে নিলো তারা। মিনিট খানেকের ভিতর লাইভ শেষ করে দৌড়ে গেলাম সেখানে। কয়েকজন শ্রমিক বলতে শুরু করলো, সেই নারী নাকি ছুরি দিয়ে শ্রমিক মারতে আসছে। সেই গুজব মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো সাইনবোর্ডের শত শত শ্রমিকের কাছে। ওই নারীকে মারতে সেখানে জড়ো হয় অন্তত দুশো মানুষ!

জানি না কী মনে করে, ঝাঁপিয়ে পড়ে, শ্রমিকদের ঠেলে ওই নারীর কাছে গিয়ে আগলে ধরলাম তাকে। পিঠে কয়েকটা কিল-ঘুষিও পড়ল তখন। শুরু করলাম ওই মারমুখীদের সাথে চিৎকার আর তর্ক। ওদের ভাষ্য, ওই নারী ছুরি দিয়ে শ্রমিক মারতে আসছে, তাই তারা তাকে পিটিয়েই মেরে ফেলবে। আমাকে তখন শতশত মানুষ বলছে, আপনি সরে যান, ওকে মেরেই ফেলবো। আমাকে সরাতে ধাক্কাও দিলো কয়েকজন। মারমুখী সবার তখন রক্তচক্ষু। এটা দেখে, আরো শক্ত হলাম। জানি না কোন শক্তি আমার উপর ভর করেছিল তখন। একাই প্রায় ১০-১৫ জনকে ঠেলে সরালাম। আমি আমার পরিচয় দিয়ে, টিভির মাইক্রোফোন উঁচু করে বললাম, পারলে মহিলার গায়ে হাত দিয়ে দেখেন, তারপর কী করি।

জানি ওরা মারা শুরু করলে আমার কিছুই করার থাকবে না। চোখের নিমেষেই নিথর হয়ে যাবে হতভাগ্য এই নারী। এসব ভেবেই আরো শক্ত হয়ে দুই হাত দিয়ে আগলে দাঁড়ালাম। মিনিট ১৫ ধরে এরকম চিৎকার-চেচামেচির পর কয়েকজন দূরে সরে গেলো। একজন টিভি সাংবাদিক ওই নারীকে ঠেকাতে আসছে, এটা দেখে কেউ কেউ পিছিয়েও গেলো।

খানিকটা নিরাপদে এনে ওই মহিলাকে নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু, অনেক মানুষের চিৎকারের আওয়াজে তার নাম ঠিকানা মনে নেই। শুধু মনে আছে সে বলছিল, ফেনী থেকে তার মুমূর্ষু মাকে নিয়ে ঢাকায় হাসপাতালে আসছিল। পথে শ্রমিকদের অবরোধে আটকা পড়ে অ্যাম্বুলেন্স। প্রায় ৫-৭ কিলোমিটার হেঁটে, সাইনবোর্ডে আসে শ্রমিকদের সাথে কথা বলে তার অ্যাম্বুলেন্স বের করে দেয়া যায় কিনা। এতোপথ হেঁটে আর মাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ওই নারীর অবস্থা তখন পাগলপ্রায়। এসময় আড়াআড়ি করে রাখা একটি বাসের হেলপারের সাথে তার ঝগড়া হয়।

তারপরই রটানো হয়, তিনি নাকি ছুরি নিয়ে শ্রমিক খুন করতে এসেছে। এই গুজব ছড়িয়ে, তাকে গণপিটুনি দিতে উদ্যত হয় শতশত মানুষ। এরপর থেকেই ওই ঘটনা বারবার ভাবছি যে, নাম ভুলে যাওয়া ওই নারী বড় ধরনের বিপদের হাত থেকেই বেঁচে গেছেন হয়তো। আমিও আমার দায়িত্বের বাইরে গিয়ে, শ্রমিকদের সাথে ঝগড়া-ঠেলাঠেলি করে বাঁচাতে পেরেছি একজন মানুষকে। নারীটিকে একদম নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে মিনিট খানেক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পরে একটা সাক্ষাৎকার নেয়ার কথা মাথায় এলেও আর খুঁজে পাইনি তাকে।

(ঘটনাস্থলে থাকা আলোকচিত্রী রাশেদ সুমন ছবিটি তুলেছেন।)

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, যমুনা টেলিভিশন।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply