বেশ কিছুদিন ধরেই নানা অভিযোগ ছিল যুবলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেগুলো প্রকাশ্যে এসেছে খুব সামান্যই। কোথায় যেন একটা ভীতি ছিলো। গত ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুবলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলে বিষয়টি প্রাদপ্রদীপের আলোয় আসে।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা (ঢাকা মহানগর যুবলীগের একটি অংশের সভাপতি) ক্রসফায়ার থেকে বেঁচে গেছে। আরেকজন (মহানগর দক্ষিণের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক) এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন। সদলবলে অস্ত্র নিয়ে ঘোরেন। এসব বন্ধ করতে হবে। যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে তখন কেউ অস্ত্র নিয়ে বের হয়নি, অস্ত্র উঁচিয়ে প্রতিবাদ করেনি। যখন দলের দুঃসময় ছিল তখন কেউ অস্ত্র নিয়ে দলের পক্ষে অবস্থান নেয়নি। এখন টানা তিনবার সরকারে আছি। অনেকের অনেক কিছু হয়েছে। কিন্তু আমার সেই দুর্দিনের কর্মীদের অবস্থা একই আছে। যারা অস্ত্রবাজি করেন, যারা ক্যাডার পোষেন, তারা সাবধান হয়ে যান, এসব বন্ধ করুন। তা না হলে, যেভাবে জঙ্গি দমন করা হয়েছে, একইভাবে তাদেরকেও দমন করা হবে।
এরপরই যুবলীগের নেতাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকার ইয়ংমেন্স ক্লাবে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ক্যাসিনোর সন্ধান পায় র্যাব। সেটি পরিচালনা করতেন যুবলীগ নেতা খালিদ মাহমুদ ভূঁইয়া। একই সময়ে তাকেও অভিযান চালিয়ে আটক করা হয়। এরপর একে একে যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অনেকে গা ঢাকা দেন।
গত ৬ অক্টোবর গ্রেফতার হন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। প্রতাপশালী সম্রাটকে নিয়ে পরে তার কার্যালয়েও অভিযান পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর থেকেই যেন যুবলীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অস্থিরতা নেমে আসে। সেটি আরও তীব্র হয় গত ২০ অক্টোবর ‘দোর্দণ্ড প্রতাপশালী’ যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার পর। এরপর থেকে যুবলীগের চেয়ারম্যানসহ একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্যের জন্য বন্ধ হয়ে যায় গণভবনের দরজা।
এমন নাজুক অবস্থায় নতুন নেতৃত্বে সন্ধান শুরু হয়। নানা জল্পনা-কল্পনার মাঝেই যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনির বড় ছেড়ে শেখ ফজলে শামস পরশের ওপরই আস্থা রাখেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলা চলে রাজনীতি থেকে দূরে থাকা শেখ পরশ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হলেন। জানা গেছে, প্রথমদিকে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন শেখ পরশ। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হলেও অনেকটা অভিমান থেকেই কিনা রাজনীতিতে সক্রিয় হননি শেখ পরশ। ছোটবেলাতেই রাজনৈতিক কারণে বাবা-মা’কে হারিয়েছিলেন তিনি। যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে তাকে সপরিবারে হত্যার ঘটনা শেখ পরশের মনে বড় ধরনের ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল। এমনকি ছোটভাই তাপসের নির্বাচনী প্রচারেও তাকে খুব একটা নামতে দেখা যায়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আলাপের পর সকল দ্বিধা দূর করে রাজনীতির মাঠে আসলেন শেখ পরশ।
সম্মেলন প্রস্তুতি দেখতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শুক্রবার যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়েছিলেন তখন তার সঙ্গে শেখ পরশ ছিলেন। গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে ওবায়দুল কাদের বলেন, যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনির উত্তরাধিকারীকে নেতৃত্বে পাওয়ার অধিকার যুবলীগের আছে। এরপর, শেখ পরশের নেতৃত্বে আসার বিষয়টা ওপেন সিক্রেট হয়ে যায়।
পরশের ভাই শেখ ফজলে নূর তাপস আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। তাদের চাচা শেখ ফজলুল করিম সেলিম আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তিনিও যুবলীগের চেয়ারম্যান ছিলেন।
পঁচাত্তর ট্রাজেডিতে বাবা-মাকে হারানো পরশ ধানমণ্ডি সরকারি বালক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেয়ার পর দেশে ফিরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে আসছিলেন তিনি।
ক্লিন ইমেজের অধিকারী শেখ পরশ কি যুবলীগের জন্য ‘পরশ পাথর’ হতে পারবেন? এই প্রশ্নটিই এখন সর্বমহলে। পারিবারিক প্রেক্ষাপট ও ব্যক্তিত্ব বিবেচনায় শেখ পরশকে নিয়ে প্রত্যাশার পারদটাও যেন একটু বেশিই।
Leave a reply