বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য ভুটান ভ্রমণের খরচ বাড়ছে- এমন খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। তবে সেই বাড়তি খরচের পরিমাণ আসলে কত এবং কবে থেকে তা কার্যকরী হচ্ছে তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
প্রথমত, ভুটান সরকার তাদের দীর্ঘদিনের পর্যটন নীতিমালায় পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয় পর্যটন নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছে দেশটির। খসড়া নীতিমালাটি আগামী মাসে (ডিসেম্বরের শেষ দিকে) মন্ত্রিসভায় উঠবে অনুমোদনের জন্য। (নীতিমালাটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে)।
নতুন পর্যটন নীতিমালায় (খসড়া) প্রস্তাব করা হয়েছে আঞ্চলিক পর্যটকদের জন্য ভিসা প্রসেসিং ফি আরোপের জন্য। এছাড়া ‘সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ফি’ও আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এসব ফি’র পরিমাণ কত বা কবে থেকে সেগুলো আরোপ করা হবে তার কোনো প্রস্তাব নেই। মন্ত্রিসভা নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুমোদন করলে পরে জাতীয় ট্যুরিজম কাউন্সিল নির্ধারণ করবে ‘আঞ্চলিক পর্যটক’দের জন্য এসব ফি কত হবে।
ভুটানের কাছে ‘আঞ্চলিক পর্যটক’ হলেন বাংলাদেশ, ভারত ও মালদ্বীপের পর্যটকরা। এই তিন দেশের নাগরিকদের জন্য বর্তমানে ভুটান যেতে কোনো ভিসা লাগে না। ফলে ভিসা ফি’ও দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
অন্যদিকে এই তিন দেশ ব্যতিত অন্যান্য সব দেশের পর্যটকদেরকে ‘আন্তর্জাতিক পর্যটক’ বলে ভুটান। এসব আন্তর্জাতিক পর্যটককে ভুটানে যেতে হলে অবশ্যই সরকার অনুমোদিত ট্যুরিস্ট এজেন্টদের মাধ্যমে যেতে হয়। ট্যুরিস্ট এজেন্টরা ভিসা প্রক্রিয়াকরণ থেকে শুরু করে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
বর্তমান নিয়মে একজন আন্তর্জাতিক পর্যটক একদিনের জন্য ভুটানে যেতে হলে তাকে নূন্যতম ২৫০ ডলারের প্যাকেজের অধীনে যেতে হয় (অফি সিজনে ন্যুনতম ২০০ ডলার)। এই প্যাকেজে থাকা, খাওয়া, পানীয়, ভিসা ফি (৪০ ডলার) এবং সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ফি (৬৫ ডলার) অন্তর্ভূক্ত। কেউ চাইলে এর আরও বেশি দামের প্যাকেজও নিতে পারেন। এতে খাবার, পানীয় ও থাকার মান বাড়বে।
(এখানে উল্লেখ্য, কেউ একদিনের বেশি ভুটানে অবস্থান করলে পরবর্তী দিনগুলোর জন্য তার প্যাকেজের ২৫০ ডলার থেকে ভিসা ফি’র ৪০ ডলার বাদ যাবে।)
বর্তমান ভিসা নীতি অনুযায়ী, বাংলাদেশ, ভারত ও মালদ্বীপের নাগরিকদের ভিসা ফি (৪০ ডলার) এবং সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ফি (৬৫ ডলার) দেয়া লাগতো না। তাদের জন্য কোনো প্যাকেজ নির্ধারিতও ছিল না। নিজেদের মতো করে স্বল্প খরচে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারতেন।
কিন্তু নতুন প্রস্তাবিত নীতিমালায় ভুটান সরকার চাচ্ছে এই তিন দেশের পর্যটকদের ওপরও ভিসা ফি এবং সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ফি আরোপ করতে। তবে এই ফি কত হবে তা এখনও নির্ধারিত হয়নি (এবং কবে থেকে বাস্তবায়িত হবে তাও নির্ধাতি হয়নি)।
আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য এই দুই খাতে বর্তমানে যে পরিমাণ ফি আছে তা যদি এই তিন দেশের নাগরিকদের জন্যও নির্ধারণ করা হয় তাহলে পরিমাণ হবে ১০৫ ডলার (৪০+৬৫), যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯ হাজার টাকার মতো।
আবার বাংলাদেশ, ভারত ও মালদ্বীপের পর্যটকদের জন্য থাকা, খাওয়া এবং উপরিউক্ত দুটি ফি-সহ নূন্যতম কোনো প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে কিনা- তাও নিশ্চিত নয়। ফলে এই তিন দেশের পর্যটকদের ভুটান ভ্রমণের খরচ আদৌ কত বাড়বে তা এখনই নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই।
লোনলি প্ল্যানেট নামক পর্যটন পোর্টাল অনুসারে থিম্পুর বাজেট হোটেলের এক রাত থাকার খরচ ২০ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যে, রেস্তোরাঁয় একজনের খাবার খরচ ৭ থেকে ১৫ ডলারের মধ্যে। বাংলাদেশি, ভারতীয় ও মালদ্বীপের নাগরিকরা বেশিরভাগ এইসব বাজেট হোটেলেই থাকেন।
নীতিমালা বদলের প্রস্তাব কেন:
ভূটানের উদ্বেগের কারণ হল পর্যটকের স্রোতের কারণে সে দেশের ভঙ্গুর হিমালয় প্রতিবেশের উপর প্রভাব পড়েছে।
ভূটানে সবচেয়ে বেশি পর্যটক যান ভারত থেকে- ২০১৮ সালে ভূটানের মোট ২ লক্ষ ৭৪ হাজার পর্যটকের মধ্যে ১ লক্ষ ৮০ হাজার বা ৬৬ শতাংশ ছিলেন ভারতীয়। এর পরে রয়েছে বাংলাদেশিদের অবস্থান। গত বছর দেশটিতে গিয়েছেন ১০ হাজারের বেশি পর্যটক।
আঞ্চলিক এই বিশাল সংখ্যক পর্যটককে ভিসা ফি এবং সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ফি না দিতে হওয়ায় ভূটান বেশ কিছু পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
এ বছরের এপ্রিল মাসে ভূটানের সংবাদপত্র কুয়েনসেলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেশের চতুর্থ পে কমিশন আঞ্চলিক পর্যটকদের জন্য সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ফি যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানান হয়।
৫০০ গুলট্রাম (ভুটানি মুদ্রা) মাথাপিছু যদি ধার্য করা হয় তাহলে বছরে ৪২৫ মিলিয়ন গুলট্রাম আনুমানিক রাজস্ব আদায় হবে বলে ওই রিপোর্টে বলা হয়। কমিশন একই সঙ্গে সরকারকে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য ধার্য সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ফি ৬৫ ডলার থেকে বাড়ানো যায় কিনা তাও খতিয়ে দেখার প্রস্তাব দেয়। কমিশনের যুক্তি ছিল গত ৪০ বছর ধরে এই হার অপরিবর্তিত রয়েছে।
ভুটানের মুদ্রা গুলট্রামের মান বাংলাদেশি টাকার চেয়ে অল্প কিছুটা বেশি। ১ গুলট্রাম সমান ১ দশমিক ১৮ টাকা।
কুয়েনসেলের রিপোর্টে ভুটানের পর্যটন পরিষদের ডিরেক্টর জেনারেল দোর্জি ধ্রাধুলকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, “ফুন্টশোলিংয়ে যেসব আঞ্চলিক পর্যটকরা আসেন এবং তাঁদের নিয়ন্ত্রণ এবং তাঁদের জন্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় তাঁদের এবং অন্য অতিথিদেরও অসুবিধার মুখে পড়তে হচ্ছে।”
“এই আঞ্চলিক পর্যটকরা নিজেরা আসেন, তাঁদের গাইড করার কেউ থাকে না, ফলে তাঁরা অনেকসময়ে এমন কাজকর্ম করে ফেলেন যা গণ্ডির বাইরে চলে যায়। গাইড না থাকার কারণে কোনটা করা যায়, কোনটা করা যায় না সে সম্পর্কে তাঁদের সম্যক ধারণা থাকে না। এতে তাঁদের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয় যা ঠিক নয়।”
সূত্র: ইকোনোমিক টাইমস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ইউএস নিউজ, কুয়েনসেল।
Leave a reply