সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ২০১৮ সালের বসন্তে তিন সপ্তাহের আন্তঃদেশীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্রে যান। মূলত সৌদি আরবের প্রগতিশীল ভিশন তুলে ধরতেই ছিল তার এ সফর।
এই সফরে মার্কিন ধনকুবের ও দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টের মালিক জেফ বেজোসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সৌদি যুবরাজ। এ সময়েই মোহাম্মদ বিন সালমানের কড়া সমালোচনা করে জামাল খাসোগির লেখা প্রতিবেদন ছাপায় বেজোসের ওয়াশিংটন পোস্ট। এর পরই বেজোসের ফোন হ্যাকড হয়। ব্লুমবাগের প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন সফরে তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে একটি নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথাই বলে এসেছেন সৌদি যুবরাজ। এ ছাড়া মার্কিন অভিজাতদের আকর্ষণও ছিল তার অন্যতম লক্ষ্য।
এ সময় তিনি এমআইটি ও হার্ভাডে যান। রিচার্ড ব্রানসনের সঙ্গে মহাকাশ সফর নিয়ে কথা বলেন। অপেরা উনফ্রেসহ মার্কিন জনপ্রিয় তারকাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
তখন বিভিন্ন ব্যবসায়ী নির্বাহীদের সঙ্গেও তার আলোচনা হয়। যাদের মধ্যে আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোস ছিলেন। সৌদি যুবরাজের এটি ছিল সত্যিই বহু আকাঙ্ক্ষিত এক বৈঠক। আমাজনের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা আমাজন ওয়েব সার্ভিস ও ই-কমার্স সাইট তাদের কার্যক্রম মধ্যপ্রাচ্যে সম্প্রসার করতে আগ্রহী ছিল।
ঠিক এ সময়েই জেফ বেজোসের মালিকানাধীন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে সৌদি যুবরাজের সমালোচনা করে নিবন্ধ লেখেন সাংবাদিক জামাল খাসোগি।
৪ এপ্রিল লসঅ্যাঞ্জেলেসে যুবরাজ ও বেজোস নৈশভোজে একত্রিত হন। তখন দুই ব্যক্তির মধ্যে কী কথা হয়েছে, তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে তাদের মধ্যে ফোন নম্বর বিনিময় ঘটেছে বলে পরিষ্কার হওয়া গেছে।
এর সপ্তাহ চারেক পর যুবরাজের অ্যাকাউন্ট থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি বার্তা পান বেজোস। কোনো ধরনের ব্যাখ্যা ছাড়াই হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিত এই বার্তা আসে বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবেরের ফোনে। এর অর্থ দাঁড়ায়– এই বার্তার বিষয়ে দুপক্ষের মধ্যে আগে কোনো আলোচনা হয়নি।
বার্তাটিতে ৪ দশমিক ২২ এমবির একটি ভিডিও ছিল। এটি গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বেজোসের ফোন থেকে ব্যাপক আকারের তথ্য কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই অন্যত্র চলে যায়।
জাতিসংঘের দুই কর্মকর্তার বরাত দিয়ে মঙ্গলবার গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন বলছে, সৌদি সিংহাসনের উত্তরসূরি মোহাম্মদ বিন সালমানের আ্যাকাউন্ড থেকে পাঠানো বার্তা গ্রহণের পরেই বেজোসের ফোন হ্যাকড হয়েছে।
এক বিবৃতিতে ওই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা যেসব তথ্য পেয়েছি, তা এমন আভাস দিচ্ছে যে বেজোসের ওপর নজরদারি করতেই এই হ্যাকিংয়ের সঙ্গে যুবরাজের যোগসাজশের আশঙ্কা রয়েছে। সৌদি আরবকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশে ওয়াশিংটন পোস্ট যদি ক্ষান্ত না হয়, সে জন্য পত্রিকার ওপর প্রভাব ফেলতেই এমনটি করা হতে পারে।
তবে এই হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে ওয়াশিংটনে অবস্থিত সৌদি দূতাবাস। তারা এটিকে উদ্ভট দাবি বলে আখ্যায়িত করেছে।
জাতিসংঘের বিস্তারিত বিবৃতিতে একটি উল্লেখযোগ্য মন্তব্য যুক্ত করা হয়েছে, বেজোসের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক আছে বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পরে তার বিব্রতকর ব্যক্তিগত ছবি ও বার্তা প্রকাশের হুমকি দিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছে মার্কিন ট্যাবলয়েড ন্যাশনাল ইনকোয়ারার।
কীভাবে এই তথ্য ফাঁস হয়েছে, তা জানতে নিরাপত্তা বিশ্লেষক গ্যাভিন ডে বেকারের নেতৃত্বে একটি তদন্ত করেছে বেজোসের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দল। বেকার বলেন, ওয়াশিংটন পোস্টের মালিক হিসেবে জেফ বেজোসকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে সৌদি সরকার।
তার কয়েক মাস আগে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে নির্মমভাবে হত্যা করে সৌদি গোয়েন্দারা।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের মতে, এই হত্যাকাণ্ডে সৌদি সরকারের এবং যুবরাজের ব্যক্তিগত ভূমিকা নিয়ে বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
এর পরে অনলাইনে বেজোসের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনলাইন প্রচার শুরু হয়। ২০১৮ সালের নভেম্বরে সৌদি টুইটারে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত হ্যাশট্যাগ ছিল ‘আমাজন বর্জন’।
২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর যুবরাজের অ্যাকাউন্ট থেকে আরেকটি বার্তা পান বেজোস। তখন স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের দিকে যাচ্ছিলেন এই ধনকুবের।
তদন্ত শেষে বেকার এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, সৌদিরা বেজোসের ফোনে ঢুকতে সক্ষম হয়েছে এবং তার ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তদন্ত এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। বেজোসের আইফোন এক্স বিশ্লেষণ করতে ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ডি বেকার এফটিআই কনসালটিংয়ে ভাড়া করেন।
সুসজ্জিত ও নিরাপদ ল্যাব এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। বেজোসের ফোনের ফরেনসিক ছবি নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্যান্ডবক্স নেটওয়ার্কে ফোনের আচরণও যাচাই করে দেখা হয়েছে।
এতে দেখা গেছে, যুবরাজের অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভিডিও গ্রহণের পর নাটকীয়ভাবে বেজোসের ফোন পরিবর্তন হয়ে যায় এবং বিপুলসংখ্যক উপাত্ত ফোন থেকে বেরিয়ে গেছে। হোয়াটসঅ্যাপের ওই বার্তা পাওয়ার আগে তার ফোনের ইগ্রেস বা তথ্য বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল ৪৩০ কেবি। কিন্তু ওই ভিডিওটি আসার পর তা বেড়ে ১২৬ এমবিতে পৌঁছে যায়।
গত নভেম্বরে এফটিআই কানসালটিং তাদের প্রতিবেদন শেষ করে। পরে খাসোগি হত্যার তদন্তের দায়িত্বে থাকা বিশেষজ্ঞদের কাছে তা পাঠিয়ে দেয়।
Leave a reply