বাদুড় থেকে চীনা ক্রেইট ও চীনা কোবরা সাপে এবং সাপ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে চীনে নতুন আবিষ্কৃত করোনা ভাইরাস। গবেষকরা বর্তমানে এমনটাই ধারণা করছেন। চীনের লোকজন শীতের শেষদিকে মারাত্মক শ্বাসনালীর সংক্রমণজনিত প্রাদুর্ভাবে আক্রান্ত হয়। এতে নাগরিকরা আতঙ্কিত রয়েছেন। এই আতঙ্ক ক্রমেই চীন ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বিস্তার লাভ করছে।
করোনা ভাইরাস চীনের হুবেই রাজ্যের উহান শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রথম ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত চীনে ৫৫৫ জন আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। এদের মাঝে ৪৪৪ জন রোগী উহান শহরের, ২৬ জন গুয়াংডং প্রদেশের, ১৪ জন বেইজিং শহরের এবং ৯ জন সাংহাই শহরের বাসিন্দা।
চীন থেকে এ ভাইরাস ইতোমধ্যে নানাভাবে দ্রুত তাইওয়ান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ছড়িয়ে গেছে। এছাড়াও চীনের উহান থেকে ম্যাকাও যাওয়া এক ব্যক্তির শরীরেও এই ভাইরাসজনিত রোগ পাওয়া গেছে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। চীনের বিজ্ঞানীরা রোগী থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ভাইরাসের জেনেটিক কোড নির্ধারণ করেন। এরপর অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে সেগুলোর ছবি তোলেন। তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হন করোনা ভাইরাস দিয়ে রোগটি ছড়াচ্ছে।
এই করোনা ভাইরাস সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম করোনা ভাইরাস বা সার্স (SARS-CoV) এবং মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম করোনা ভাইরাস বা মার্স (MERS-CoV) এর পরিবারভুক্ত ভাইরাসের অনুরূপ। এই দুটি ভাইরাস গত ১৭ বছর ধরে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে চলে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নতুন এই করোনা ভাইরাসকে ‘২০১৯-এন করোনা ভাইরাস’ নাম দিয়েছে।
করোনা ভাইরাস নামটি এসেছে এর আকৃতির ওপর ভিত্তি করে। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে ক্রাউন বা মুকুটের মতো দেখতে হওয়ায় এর নাম হয়েছে করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখিতে প্রাথমিক অবস্থায় শ্বাসনালীর উপরের দিকে ও পরিপাকতন্ত্রের নালিতে সংক্রমণ ঘটায়।
যদিও অধিকাংশ করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত রোগীর মধ্যে হালকা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো উপসর্গ প্রকাশ পায় কিন্তু সার্স ও মার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে মানুষের শ্বাসনালীতে সংক্রমণ প্রকাশ পায়। এছাড়াও নানা ধরনের জটিলতাও দেখা দেয়।
নতুন ‘২০১৯-এন করোনা ভাইরাস’ দ্বারা আক্রান্ত হলেও সার্স এবং মার্স ভাইরাসের মতো উপসর্গ প্রকাশ পায়। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মানুষের শ্বাসনালী তীব্র সংক্রমণে আক্রান্ত হয়। ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো এর কোনো প্রতিষেধক টিকা ও চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি।
যেহেতু প্রতিষেধক টিকা ও চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি তাই রোগ প্রতিরোধে এই ভাইরাসের উৎস, রোগ বিস্তারের উপায়, পুনরুৎপাদন পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হবে।
সার্স ও মার্স ভাইরাস জুনোটিক রোগ। এগুলো প্রাণী থেকে মানুষে ছড়ায়। এরপর মানব শরীরে জীনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে আক্রান্ত করে ও বংশবিস্তার করে। বর্তমানে এই ভাইরাসগুলো আক্রান্ত মানুষ থেকে সুস্থ মানুষেও বিস্তার লাভ করছে।
সার্স ও মার্স ভাইরাসের আসল উৎস হচ্ছে বাদুড় ও গন্ধগোকুল। অপরদিকে বাদুড় ও মানুষের মাঝে ছড়ানোর জন্য ইন্টারমিডিয়েট হোস্ট বা মধ্যবর্তী পোষক হিসেবে কাজ করে উট।
বর্তমানে নতুন করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিরা যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তারা সকলেই সিফুডের পাইকারি ক্রেতা অথবা বিক্রেতা ছিলেন। সেখানে মুরগি, গাধা, ভেড়া, শুকর, উট, শেয়াল, ইঁদুর, সজারু ইত্যাদি বিক্রি হতো। কিন্তু ওই সকল প্রাণীতে করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়নি।
‘জার্নাল অব মেডিকেল ভাইরোলজি’তে প্রকাশিত গবেষণাপত্র থেকে জানা যায় নতুন করোনা ভাইরাস সার্স ও মার্স ভাইরাসের খুবই নিকট বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। তাই গবেষকরা প্রথমে ধরে নিয়েছিলেন এটি বাদুড় থেকেই সরাসরি মানুষকে সংক্রমিত করেছে।
কিন্তু যখন গবেষকরা বিস্তারিত তথ্য বিশ্লেষণ করেন তখন বলেন, সম্ভবত নতুন ‘২০১৯-এন করোনা ভাইরাস’ সাপ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে। কিন্তু এর সূত্রপাত বাদুড় থেকে হয়ে থাকতে পারে বলেই তাদের ধারণা। এর ফলে সিফুডের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছিল বলে কথাটি বন্ধ হয়ে যায়।
করোনা ভাইরাস পাওয়া যায় এমন সকল প্রাণী নিয়ে গবেষকরা প্রোটিন কোড বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তারা সাপের ক্ষেত্রে নতুন করোনা ভাইরাসের প্রোটিন কোডের মিল খুঁজে পান।
চীনে প্রচুর ডোরাকাটা ক্রেইট সাপ রয়েছে। Bungarus multicinctus হচ্ছে সাপটির বৈজ্ঞানিক নাম। সাপটিকে তাইওয়ানিজ ক্রেইট এবং চাইনিজ ক্রেইটও বলা হয়। ইলাপিড পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এই সাপ খুবই বিষাক্ত, যা চীনের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রচুর পাওয়া যায়।
সাপ মূলত বাদুড় শিকার করে। এই সাপ আবার উহানের স্থানীয় সিফুড মার্কেটে বিক্রি হয়। সেখান থেকেই নতুন করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাদুড় থেকে সাপের মাধ্যমে এই রোগ ছড়িয়েছে বলা হলেও শীতল ও উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট প্রাণীতে এই ভাইরাস কীভাবে বসবাস করছে তা এখনো রহস্যই রয়ে গেছে। তবে বন্য জীবজন্তু শিকার করে খাওয়া যে উচিত নয় এই নতুন করোনা ভাইরাস আবারও বিশ্ববাসী তথা চীনের অধিবাসীদের মনে করিয়ে দিচ্ছে।
সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার।
Leave a reply