গাইবান্ধায় বাসে বোমা হামলার ৫ বছর আজ, শুরু হয়নি সাক্ষ্য গ্রহণ

|

জিল্লুর রহমান পলাশ, গাইবান্ধা
গাইবান্ধার তুলসীঘাটে চলন্ত যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা হামলার ৫ বছর হলো আজ। ২০১৫ সালের এইদিনে বোমা হামলায় প্রাণ হারায় শিশুসহ আট নারী-পুরুষ। বর্বরোচিত হামলায় অভিযুক্ত ৭৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চর্জশিট দাখিল হলেও আজও শুরু হয়নি সাক্ষ্য গ্রহণ। এই মর্মান্তিক ঘটনার ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও জড়িতদের বিচার না পেয়ে ক্ষুদ্ধ ও হতাশায় নিহত ও আহতদের স্বজনসহ এলাকাবাসি। তবে অভিযুক্ত ৫ আসামির মৃত্যুজনিত কারণেই বিচার প্রক্রিয়ায় এ দীর্ঘসূত্রতার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলছেন, চলতি মাসেই স্বাক্ষ্য গ্রহণের মধ্যে দিয়ে শুরু হবে মামলার বিচারকাজ।

২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনকে প্রতিহত করার নামে দেশজুড়ে টানা হরতাল দেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। টানা হরতাল-অবরোধের সময় ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে সুন্দরগঞ্জ থেকে আসা নাপু এন্টারপ্রাইজের একটি যাত্রীবাহী বাস ঢাকা যাচ্ছিলো। রাত ১০ টার দিকে পুলিশ পাহাড়ায় সদরের তুলসীঘাটের বুড়িরঘর নামক এলাকায় পৌঁছিলে চলন্ত বাসে কয়েকটি পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। এতে পেট্রোল বোমার আগুনে পুরো বাসে আগুন ধরে যায়। ঘটনাস্থলেই বাসের ভিতরে থাকা জীবন্ত দ্বগ্ধ হয়ে মারা যায় শিশুসহ ৬ জন। দ্বগ্ধ হয় নৌশ কোচে থাকা শিশুসহ অন্তত ৩৫ জন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও আরও ২ জনের মৃত্যু হয়।

বর্বরোচিত নাশতার ঘটনার পরেরদিন বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ৬০ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৩০ জনকে আসামি করে সদর থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা করে পুলিশ। পরবর্তীতে তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে ৭৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে তদন্তকারী কর্মকর্তা। এরপর জেলা দায়রা জজ আদালতে অভিযুক্ত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জ গঠন হয়। কিন্তু ঘটনার কয়েকদিন পরেই অভিযুক্ত প্রধান আসামি মোস্তফা মঞ্জিল আইনশৃঙ্খলাবাহীনির সাথে বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হয়।

এরপর বিভিন্ন সময়ে আরও চার আাসামির মৃত্যু হয়। সর্বশেষ গেল বছরের ডিসেম্বর মাসে মামলার অপর আসামি সাহাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহাবুবুর রহমান টুলুর মৃত্যু হয়। আসামিদের মৃত্যুজনিত কারণে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণে সৃষ্টি হয় জটিলতা। মৃত্যু আসামিদের ডেট রেফান্সেসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় আজও সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি। ফলে থমকে আছে মামলার বিচার কার্যক্রম। বর্তমানে চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে একজন আসামি পলাতক ছাড়া অন্য সব আসামি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছেন।

এদিকে, পেট্রোল বোমা হামলার ৫ বছর হলেও আজও সেই ভয়াবহ স্মৃতি ও স্বজন হারানোর বেদনা ভুলতে পারেনি হতাহতের পরিবারের অনেকেই। আহতদের কেউ কেউ চিরদিনের মতো পঙ্গু হয়ে গেছেন। আবার অনেকেই শরীরে ক্ষত চিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন। হতাহতের শিকার অধিকাংশই সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র অসহায় দিনমজুর। ঘটনার পর সরকারীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সামান্য সহায়তা দিলেও আজ পর্যন্ত তাদের আর কেউ খোঁজ রাখেনি। তাছাড়া আগুন-সন্ত্রাসের ঘটনার ৫ বছর পরেও জড়িতদের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ-হতাশা বাড়ছে হতাহতদের স্বজন ও এলাকাবাসীর। দ্রুত হামলা ঘটনার বিচার ও জড়িতদের সর্ব্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেন তারা।

চণ্ডিপুর গ্রামের তারা মিয়া বলেন, ‘আগুনে স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে হারিয়েছি। কিন্তু স্ত্রী-সন্তান হত্যার আজও বিচার শুরু হয়নি। সেদিনের ঘটনা আজও মনে হলে ভয়ে আতকে উঠি। অথচ সেই জড়িতদের হত্যাকারীরা ধরাছোয়ার বাইরে। দ্রুত দোষিদের কঠোর শাস্তির দাবি করেন তিনি’।

হামলার ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া বলরাম দাস নামে দিনমজুর বলেন, ‘স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ঢাকার বালুগাঁ এলাকায় শ্রমিকের কাজ করতেন। বাড়ি থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় বাসে আগুন ধরে যায়। ঘটনার সময় তার মেয়ে শিল্পী মায়ের কোলে ঘুমিয়ে ছিলো। আগুন দেখে স্ত্রীকে নিয়ে দ্রুত বাস থেকে নামলেও শিল্পী আগুনে পুড়ে মারা যায়। আগুনে তার ও স্ত্রী শরীরও দ্বগ্ধ হয়। তার মতো অনেকেই শরীরে ক্ষত চিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন’।

দক্ষিণ কালির খামার গ্রামের নিহত সৈয়দ আলীর বাবা খয়বর হোসেন বলেন, ‘হামলার ঘটনার পাঁচ বছর কেটে গেলো। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে এখন মানবেতর জীবন কাটছে তাদের। ঘটনার পর ২০ হাজার টাকা সহযোগিতা ছাড়া আর কিছুই কপালে জোটেনি। আজ পর্যন্ত কেউ তাদের খোঁজও রাখেনি। কষ্ট করেই বেঁচে আছি তবে হামলার ঘটনার দ্রুত বিচার দাবি করেন তিনি’।

আগুনে মারা যাওয়া সুন্দরগঞ্জের চণ্ডিপুর গ্রামের সুমন মিযার বাবা শাহজাহান আলী বলেন, ‘ঢাকায় একটি কোম্পানি চাকরি করতো ছেলে। ছুটি শেষে বাড়ি থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে আগুনে পুড়ে লাশ হয়ে ফিরতে হয় তাকে। ছেলেসহ আগুনে পুড়িয়ে আটজনকে হত্যা করে হামলাকারীরা। অথচ সেই হামলাকারীরা আদালত থেকে জামিনে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ৫ বছর হলেও চাঞ্চল্যকর মামলাটি গতিহীন হয়ে পড়েছে’।

এ বিষয়ে গাইবান্ধা জেলা জজ ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এ্যাডভোকেট মো. শফিকুল ইসলাম শফিক বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর এই মামলার চার্জশিট দাখিলের পর আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জ গঠন হলেও অভিযুক্ত ৫ আসামির মৃত্যুজনিত কারণে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি। মৃত্যু আসামিদের ডেট রেফারেন্সসহ আইনী প্রক্রিয়ার কারণে বিচার কার্যক্রমে কিছুটা জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে। তবে চলতি মাসের ২০ ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষী গ্রহণের মধ্যে দিয়ে মামলার বিচার কাজ শুরু হবে’।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply