অরক্ষিত রেল ক্রসিং আর অসচেতনতায় ঢাকাসহ সারা দেশে ট্রেনে কাটা মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। কেউ সেলফি তুলতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যাচ্ছেন। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন দিয়ে হাঁটার সময় ট্রেনের নিচে প্রাণ যাচ্ছে অনেকের। আবার কেউ হেডফোনে গান শুনতে শুনতে ট্রেনে কাটা পড়ছেন।
অসতর্কতাবশত হাঁটতে গিয়ে স্লিপারে পা পিছলে নিহতের ঘটনাও ঘটছে। সময় বাঁচানোর নামে জীবন বাজি রাখতে গিয়ে দুর্ঘটনার মুখে পড়ছেন। এভাবেও অনেকের প্রাণ গেছে। রোববারও একাধিক ঘটনায় ট্রেনের নিচে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
রাজধানীর কুড়িল রেললাইনে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রাণ গেছে ইমরান হোসেন (১৬) নামে এক ছাত্রের। এ ঘটনায় আহত হয়েছে তার সহপাঠী আল রাফি (১৬)। যশোরের অভয়নগরে ট্রেনে উঠতে গিয়ে পা পিছলে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে অজ্ঞাত পরিচয়ে এক নারীর (৩০) মৃত্যু হয়েছে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণখানের কাওলার ও আশকোনার মাঝামাঝি জায়গায় রেললাইন পারাপারের সময় কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রেনের ধাক্কায় এক ব্যক্তি ঘটনাস্থলেই মারা যান। ওই দিনই কুড়িল বিশ্বরোড সংলগ্ন রেলক্রসিংয়ে পারাপারের সময় একটি ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলে এক নারী মারা যান।
এভাবে প্রায় প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটলেও সচেতন হয়নি মানুষ।
রোববার সকালে সরেজমিনে রাজধানীর খিলক্ষেত গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রেললাইন ঘেঁষে গড়ে উঠেছে পাইকারি সবজি বাজার। বাজার থেকে শাক-সবজি কিনে ভ্যানে করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। ট্রেন আসছে দেখেও অবলীলায় কাওলার রেলক্রসিং পার করছেন তাদের অনেকেই।
মাত্র কয়েক হাত দূরে ট্রেন দেখেও মাথায় বস্তা নিয়ে দৌড় দিলেন আরেক দোকানি। এভাবেই প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে রেললাইন পার হচ্ছেন মানুষ। জেনেবুঝেই দুই মিনিট সময় বাঁচানোর নামে জীবন বাজি রাখছেন তারা।
রাজধানীর শ্যাওড়াবাজার, আশকোনা, মগবাজার, এফডিসি মোড়, তেজগাঁও, মহাখালী, বনানী রেলক্রসিং ঘুরে দেখা যায় একই চিত্র। ট্রেন আসার আগ মুহূর্তে লাইনম্যান দুদিকে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা পারাপার বন্ধ করে দেন।
কিন্তু ব্যারিকেডের নিচ দিয়ে কিংবা একটু দূরে লোহার বার তুলে ঢুকে পড়েন পথচারী এবং সাইকেল- মোটরসাইকেল চালকদের অনেকেই। ট্রেন কাছাকাছি চলে এলেও নির্বিকার পার হয়ে যান তারা। শ্যাওড়া রেলক্রসিং এলাকায় দেখা যায়, সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক গেটম্যানরা সতর্কীকরণ সাইরেন বাজালেও তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই কারও।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর রেল দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০০ মানুষ মারা যায়। হতাহতের সংখ্যা প্রায় ২৫০ জনের মতো। কিন্তু চোখের সামনে এমন দুর্ঘটনা ঘটলেও সচেতনতা তৈরি হয়নি মানুষের মাঝে। রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, রেলপথের দুই পাশে ১০ ফুট এলাকায় চলাচল আইনত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
ওই সীমানার ভেতর কেউ প্রবেশ করলে তাকে গ্রেফতারের বিধান রয়েছে। এমনকি ওই সীমানায় গবাদিপশু প্রবেশ করলে তা বিক্রি করে এর অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হয়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিনা পরোয়ানায় দায়ী ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পাশাপাশি অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা রাখে।
রেললাইনে দুর্ঘটনার জন্য বেশ কিছু কারণ শনাক্ত করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এসবের মধ্যে আছে, অসচেতনভাবে রেললাইন দিয়ে হাঁটাচলা ও পারাপার।
মোবাইল ফোনে কথা বলা বা কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনে শুনে রেললাইন দিয়ে হাঁটা। ঘনবসতি এলাকা দিয়ে ট্রেন চলাচলের সময় ট্রেনের হুইশেল শুনতে না পাওয়া। আঁকাবাঁকা পথে ট্রেন দেখতে না পাওয়া। ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করা। নেশাগ্রস্ত হয়ে রেললাইনে চলাচল অন্যতম।
সূত্র মতে, রাজধানীসহ আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের ২৩টি অরক্ষিত ও অননুমোদিত। এর মধ্যে কোনোটিতে নেই গেটম্যান ও সিগন্যাল বার। কমলাপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত অংশকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে রেলওয়ে। কুড়িল বিশ্বরোড রেলক্রসিংয়ে দেখা যায়, কিছুক্ষণ পর পরই ট্রেন আসা-যাওয়া করছে। এর মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে পারাপার করছে মানুষ।
কমলাপুর রেলওয়ে (জিআরপি) থানার ওসি রকিবুল হোসেন সচেতনতার অভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এটা রোধে রেলপথ মন্ত্রণালয়, রেলওয়ে পুলিশের পাশাপাশি রেললাইন দিয়ে চলাচলকারীদেরও সচেতন হতে হবে।
Leave a reply