অপকর্মের বিষয়ে মুখ খুলছেন পাপিয়া; নাম বলছেন সংশ্লিষ্টদের

|

রাজধানীর অন্ধকার রাজ্যে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাতারাতি বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে উঠেছেন যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। র‍্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে পাপিয়াকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের অপরাধ জগতের চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন পাপিয়ে।

পুলিশের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, সাধারণ ঘরের মেয়ে পাপিয়া কীভাবে কতিপয় প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় রাতারাতি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে গেছেন সে বিষয়ে মুখ খুলেছেন। জানিয়েছেন তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জনের নামও।

ঢাকা ও নরসিংদীতে একাধিক ফ্ল্যাট-প্লট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক পাপিয়ার বাবা একজন অটো গ্যারেজের মালিক। বাবা কষ্টে জীবন-যাপন করলেও অবৈধ টাকায় ঢাকায় আয়েশী জীবন যাপন করতেন পাপিয়া। মদ-জুয়া নিয়ে ফূর্তি ও মাস্তিতে সারাক্ষণ মেতে থাকতে পছন্দ করতেন পাপিয়া।

পাপিয়া নরসিংদীর বাগদী এলাকায় পেট্রোবাংলার অবসরপ্রাপ্ত গাড়িচালক সাইফুল বারীর মেয়ে। বর্তমানে তার বাবার নিজ এলাকায় একটি অটোর গ্যারেজ রয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকটি অটো গাড়ি ভাড়া দিয়ে চলে সাইফুলের সংসার।

সম্প্রতি পাপিয়া নরসিংদীতে দু’তলা বিশিষ্ট আধুনিক একটি বাড়ি করেছেন। তার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন সেখানকার গানের শিক্ষক মতিউর রহমান চৌধুরীর বড় ছেলে। মতিউর রহমান স্থানীয় নজরুল একাডেমির অধ্যক্ষের দায়িত্বে রয়েছেন।

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সুমনকে বিয়ে করেই ভাগ্যের চাকা ঘুরে পাপিয়ার। সুমনই তাকে অপরাধ জগতের অলিগতি চেনাতে ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে যুব মহিলা লীগের পদ পেয়ে অল্প সময়েই পাপিয়া ক্ষমতার সিঁড়ি ব্যবহার করে হয়ে উঠেন অগাধ সম্পদের মালিক। যুব মহিলা লীগ ও আওয়ামী লীগের কতিপয় প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় পাপিয়া হয়ে উঠেন বেপরোয়া। একে একে তাদের সম্পর্কে মুখ খুলছেন পাপিয়া।

পাপিয়া ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পান। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। শুরু হয় অস্বাভাবিক উত্থান। আর এ সবই করেছেন রাজধানী ঢাকায় বসে। মাঝে মধ্যেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের মিটিং-মিছিলে দলবল ও বহর নিয়ে যোগ দিতেন পাপিয়া-সুমন দম্পতি।

সুমন শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক ও তার স্ত্রী পাপিয়া যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় এলাকায় তাদের বিশাল কর্মীবাহিনী গড়ে উঠে। বিশাল শোডাউন আর শত শত লোকজন নিয়ে আওয়ামী লীগের মিছিল, সভায় যোগ দিতেন তারা।

র‌্যাব জানিয়েছে, পাপিয়ার সব কর্মকাণ্ডের অন্যতম অংশীদার তার স্বামী সুমন। এই সুমনই একসময় নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক পদে ছিলেন। পরে নরসিংদীর প্রয়াত পৌর মেয়র লোকমানের বডিগার্ড হন। ২০১২ সালের অক্টোবরে সুমন নরসিংদীর বাসাইলে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন এবং এই ঘটনায় তার স্ত্রী পাপিয়া গুলিবিদ্ধ হন। ঢাকায় এসে যুব মহিলা লীগের এক নেত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন পাপিয়া। ওই নেত্রীর মাধ্যমেই বিস্তৃত হতে থাকে তার বলয়। অনেকের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়ান, গড়ে তোলেন এক বিশাল সিন্ডিকেট।

২০১৪ সালে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল সম্মেলন করলেও নরসিংদীতে কমিটি দিতে পারেননি। পরে ঢাকায় ফিরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নরসিংদী জেলা কমিটি ঘোষণা করেন, তাতে পাপিয়াকে দেয়া হয় সাধারণ সম্পাদকের পদ।

নরসিংদীর নেতাদের অনেকের দাবি, তাদের বিরোধিতার মুখে ঢাকায় গিয়ে পাপিয়াকে পদ দিয়ে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল।

এ বিষয়ে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানান, জেলা কমিটিতে পাপিয়া আগে কোনো পদে না থাকলেও তাকে পদ দিতে অনেকটা বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

নাজমা বলেন, নরসিংদীর একটি পক্ষ এই মেয়েকে পদ না দেয়ার জন্য আমাদের বলেছিল। আমি পাপিয়াকে পদ দেয়ার পক্ষে ছিলাম না। তারপরও শেষ পর্যন্ত দিতে হয়েছে। পদ বাণিজ্য করে যারা পাপিয়াকে পদ দিয়েছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক, এমন মেয়েদের জন্য যুব মহিলা লীগের সম্মান যায়।

অন্যদিকে, পাপিয়ার অপকীর্তির বিষয়ে কিছুই জানতেন না বলে দাবি করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল।

এদিকে, একজন সাবেক নারী সংসদ সদস্যের ও যুব মহিলা লীগ নেত্রীর সাথে পাপিয়ার সখ্যের বিষয়টি খোদ যুব মহিলা লীগেই আলোচিত। পাপিয়ার নানা কাজে সেই নারী সংসদ সদস্যের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে, এমন অভিযোগও এসেছে। যদিও সেই নেত্রী এটিকে সাংগঠনিক সম্পর্কের বাইরের কিছু না বলে দাবি করেছেন।

এদিকে, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, পতিতা ব্যবসার পাশাপাশি ব্ল্যাকমেইল করে পাপিয়া ও তার স্বামী গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। অনৈতিক কার্যকলাপের ভিডিও ধারণ করে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতেন তারা। তার কাছ থেকে এমন কিছু ভিডিও উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

অস্ত্র ও মাদক মজুদের পাশাপাশি ক্যাডার বাহিনীও গঠন করেছেন পাপিয়া। এ সকল কর্মকাণ্ডে জড়িতদের ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

পাপিয়াকে আটকের পর ব্রিফিংয়ে আগে র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক জানিয়েছিলেন, পাপিয়ার আয়ের অন্যতম উৎস নারীদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করানো। ঢাকার বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে কম বয়সী মেয়েদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করতেন তিনি। যাদের অধিকাংশকে নরসিংদী এলাকা থেকে চাকরির প্রলোভনে ঢাকায় আনা হয়েছিল। অনৈতিক কাজে বাধ্য না হলে তাদের নানাভাবে নির্যাতন করা হতো।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply