মাহফুজ মিশু, চেন্নাই থেকে:
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে সপ্তাহ খানেকের সফরে তিনদিন ধরে চেন্নাইয়ে অবস্থান। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ রোববার নির্ধারিত কর্মসূচি ছিল শংকর নেত্রালয় পরিদর্শন। ছুটির দিন। তাই জরুরি বিভাগ ছাড়া চোখের এই হাসপাতালের বাকি অংশ প্রায় ফাঁকা। এমনকি অনেক ওয়ার্ডেও রোগী নেই বললেই চলে। জানতে চাইলাম, কেন? জবাব, চোখের রোগীদের ৬০ শতাংশকেই হাসপাতালে ভর্তি রাখতে হয় না। তারা বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েই বাড়ি ফিরতে পারেন।
এই হাসপাতালটির যাত্রা শুরু ডাক্তার বন্দ্রিনাথের উদ্যোগে। যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করা এই মহতী মানুষটির দর্শন ছিল ভিন্ন। তিনি ভারত তথা এই অঞ্চলের মানুষকে অন্ধত্ব থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তার ব্রত ছিল, সাধ্যের মধ্যে মানসম্মত চক্ষু চিকিৎসা। সম্ভবত সেই সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে তার কাজেও। সেজন্যই চোখের যাবতীয় জটিলতায় কেবল ভারতবর্ষ নয়, দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে নির্ভরতার নাম শংকর নেত্রালয়।
বাংলাদেশের মানুষ, তাই খুঁজতে লাগলাম আমাদের দেশের কোনো রোগী আছেন কিনা? পেয়েও গেলাম। চট্টগ্রাম থেকে আসা ষষ্ঠ শ্রেণীর রিয়াদকে। তার চোখে একটি অপারেশন সাকসেসফুল। আরো একটি করাতে হবে। খেলতে গিয়ে চোখে বলের আঘাত লেগেছিল রিয়াদের। কী ক্ষতি হয়ে গেছে সেটি বুঝেও উঠতে পারেনি তার পরিবার। হঠাৎ প্রায় অন্ধ হতে বসে ছোট্ট আর দূরন্ত শিশুটি; তারপর…এ ডাক্তার, সে ডাক্তার। চট্টগ্রামের ডাক্তাররা নাকি বলেই ফেলেছিলেন, এই চোখ আর স্বাভাবিক হবে না! সুস্থ হওয়ার সুযোগ মাত্র ২০ শতাংশ। রিয়াদের চাচাতো ভাই সাদর বলছিলেন, দুঃসহ সে সব সময়ের কথা। সবচে বড় অভিযোগ ছিল, দেশের ডাক্তাররা সময় স্বল্পতার কারণে সমস্যা ও তার ভবিষ্যত নিয়ে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলেননি বা বলতে চাননি।
রিয়াদের অবস্থা অনেকটা বেগতিক দেখেই চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ে আসেন তারা। তারপর অপারেশন। প্রথমটার খরচ পড়েছে ৪০ হাজার রুপির মত। এখানকার চিকিৎসকরাও বলছেন, অবস্থা ভালো না। তবে ভালো করার চেষ্টা তারা করছেন। সাদর বলছিলেন, হাসপাতালের পাশের একটা কফিশপে এখানকার এক ডাক্তারের সাথে দেখা। তিনি পরিচয় দিয়ে তার ভাইয়ের ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে সেই ডাক্তার মনোযোগ দিয়ে তা শোনেন, পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে ধারণা দেন। এটি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সেই তরুণের জীবনে দারুণ এক অভিজ্ঞতা! তার মতে, রোগী ও অ্যাটেনডেন্টদের সাথে ডাক্তারদের ব্যবহারই, বহু রোগীকে ভারতে নিয়ে আসে! তার ভাইয়ের আরো একটা অপারেশন লাগবে, সেটির খরচ পড়বে ৮০ হাজার রুপি। কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে যা বলেছেন, তাতে সাদরের বিশ্বাস জন্মেছে, আগের মতো দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে তার ভাই।
পরিসংখ্যান বলছে, বছরে ৫৬ হাজার রোগী কেবল বাংলাদেশ থেকেই এখানে আসে চোখের চিকিৎসা নিতে। এটা মোট বিদেশি রোগীর ৬০ শতাংশ। এই পরিমাণ বাংলাদেশি কেন আসেন ভারতে, জানতে চেয়েছিলাম শংকর নেত্রালয়ের চিকিৎসক পার্থ প্রতিম মজুমদারের কাছে। তার ব্যাখ্যা অবশ্য ভিন্ন। ঢাকার ইস্পাহানি হাসপাতালে সম্প্রতি ক্যাম্প করে আসা এই চিকিৎসক ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন বাংলাদেশি ডাক্তারদের। এটাও বলছিলেন, একজন বাংলাদেশি ডাক্তার দৈনিক গড়ে যত রোগী দেখেন, সেটা অকল্পনীয়। ভারতেও অনেক রাজ্যে একই সমস্যা। তবে কেন এত রোগী এখানে আসেন? তার মতে, অনেক ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা আর অপারেশনের সুযোগ ভারতে বেশি, সে কারণেই অনেকে এখানে আসেন। আরেকটি কারণ বললেন সেই হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার গিরিশ রাও। তার মতে, তাদের হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ সাধারণের নাগালের মধ্যে। ভারতীয় তো বটেই, ভিনদেশি কোনো রোগীও কেবল টাকার কারণে এখান থেকে চিকিৎসা না নিয়ে ফিরে যাননি।
জানা গেল, ভারতের পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন এলাকায় মোবাইল অপারেশন থিয়েটার চালু করেছে শংকর নেত্রালয়। ভাবনাটা এরকম। মফস্বল থেকে একজন যখন চোখের অপারেশন করাতে চেন্নাইয়ের মতো শহরে আসেন তখন চিকিৎসা, যাতায়াত, থাকা খাওয়া অনেক খরচ যুক্ত হয়। সাথে সঙ্গে আসা মানুষের খরচ, তার কর্মঘণ্টা নষ্ট, কতকিছু। এসব বিষয় ভেবেই আগে থেকে সব প্রস্তুতি নিয়ে রোগীর কাছাকাছি ভ্রাম্যমাণ অপারেশন থিয়েটার নিয়ে গিয়ে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করছে এই হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্রটি।
শংকর নেত্রালয়ের পরিচালক বলছিলেন, চিকিৎসার দর্শনের কথা। সেই দর্শন যদি মানবকল্যাণ আর জনস্বার্থে হয়, তারপরও মুনাফা সম্ভব। তার মানে হলো, হাসপাতালও বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করা সম্ভব, মানুষকে সর্বোত্তম আর সহনীয় দামের সেবা দিয়ে। বাংলাদেশের হাসপাতাল আর এর মালিক-মহাজন-ব্যবস্থাপকরা যতদ্রুত এই বিষয়টি আন্তরিকভাবে বুঝবেন, তত তাড়াতাড়ি মঙ্গল হবে জনস্বাস্থ্যের, চিকিৎসা ব্যবস্থার সর্বোপরি বাংলাদেশের।
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন।
Leave a reply