মাহফুজ মিশু:
সরকার স্বীকার করুক আর নাই করুক, শুরু থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বা কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। এটি প্রমাণ করার জন্য, পাঁচদিন আগ পর্যন্ত নীতিনির্ধারকদের কথাবার্তা, আচরণ আর তাদের বডি ল্যাংগুয়েজই যথেষ্ট।
অবশ্য ভুল যা হওয়ার তা হয়েছে, হয়ে গেছে। বিদ্যমান বাস্তবতা থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলা, তার কর্মকৌশল প্রণয়নে বাস্তবায়ন সবচে জরুরি। সেটি করতে পারলেও ক্ষয়ক্ষতি বিশেষ করে প্রাণহানির সংখ্যা হয়তো কিছুটা কমবে।
গেল কয়েকদিনে সরকারের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। বেশ কয়েকটি হাসপাতাল রেডি করা, নানা উপায়ে করোনা পরীক্ষার কীট জোগাড় করা, ডাক্তার নার্সসহ চিকিৎসা কর্মীদের জন্য পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট পিপিই বানানো বা জোগাড় করার সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিখাতের প্রচেষ্টা আশা জাগানিয়া।
প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টাইন প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীকে যুক্ত করাও ইতিবাচক। বেশিরভাগ দেশের সাথে বিমান চলাচল বন্ধ ভাল উদ্যোগ। কিন্তু এখনো লন্ডন হয়ে ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে যে মানুষ আসছে, সেটি কেন বন্ধ হচ্ছে না, সেটি অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়। কারণ শুনতে খারাপ হলেও সত্য, বাংলাদেশে করোনার বিস্তারে এখন পর্যন্ত ইতালি ফেরতদের ভূমিকা সবচে বেশি দৃশ্যমান। সরকার দ্রুততম সময়ে সব ফ্লাইট বন্ধ করুক অন্তত পনের দিনের জন্য, এমন পরামর্শ আসছে নানা মহল থেকে।
শনিবার সমন্বয় সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রয়োজনে চীন থেকে ডাক্তার নার্স নিয়ে আসবে সরকার। নিঃসন্দেহে সেটি ভাল উদ্যোগ। কারণ বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে পড়া স্মরণকালের সবচে বড় এই সংকটের শুরুটা চীনের উহানে। আড়াই মাস সময়ে সেই সংকটে সামলে উঠেছে বিশ্ব অর্থনীতির নতুন এই পরাশক্তি। এমনকি শুরুতে করোনা ভাইরাসের যে এপিসেন্টার, সেই উহানে গত ৩/৪ দিনে কোন আক্রান্ত ধরা পড়েনি। এমনকি এক উহান ছাড়া বৃহৎ চীনের অন্যান্য এলাকাতেও মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েনি করোনা ভাইরাস।
মোদ্দা কথা হলো, করোনা মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল চীন। রাষ্ট্রীয় কাঠামো এ শাসনপদ্ধতির কারণেই দেশটি এই সংকট সামাল দিতে পেরেছে বলে অনেকের ধারণা।
তারপরও আমাদের এই বিপদে চীন হতে পারে সবচেয়ে বড় বন্ধু। কেবল করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ নয়, বিস্তার রোধ, জনমনস্তত্ব বিনির্মাণ, আক্রান্তদের চিকিৎসা, চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা, প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণাসহ যাবতীয় ইস্যুতে চীনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ। মনে রাখতে হবে, অর্থনীতির মানদণ্ডে বাংলাদেশের যে অব্যাহত অগ্রযাত্রা, তা থমকে যেতে পারে এই সময়ের কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে। বেশিরভাগ বড় অবকাঠামোতে চীনের অংশীদারিত্ব আছে। সুতরাং বাংলাদেশ চাইলে নিজেদের বিনিয়োগ এ ভবিষ্যতের বাজার সুরক্ষায় দেশটি এগিয়ে আসার কথা।
প্রস্তাব হলো, আলাদা একটা কমিটি করে চীনের সাথে সক্রিয় যোগাযোগ বাড়ানো। বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের পাশাপাশি ঢাকা থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে কাউকে নিয়োগ করতে হবে এখনি। পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি, কূটনীতিতে পারদর্শী এবং সর্বোপরি দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ কাউকে এই দায়িত্ব দিতে পারেন সরকার প্রধান। সিনিয়র সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খান ফেসবুকে এ কাজে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের নাম প্রস্তাব করেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি বেস্ট চয়েজ। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব ডক্টর আহমেদ কায়কাউসও এই টিমে থাকতে পারেন। যুক্ত হতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া অথবা শাহ আলী ফরহাদ।
এই টিমটি দ্রুত আমাদের চাহিদা নিরুপণ করে চীনা দূতাবাসের মাধ্যমে দেশটিকে জানাক। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বেইজিং দূতাবাসকে কাজে লাগিয়ে দেশটির অনুমোদন দিক। দ্রুত বাংলাদেশে আসুক চীনের প্রতিনিধি দল। তারা তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নির্ধারণ করুক কর্মপন্থা। প্রয়োজনে বানানো হোক হসপিটাল, আইসেলেশন সেন্টার, আইসিইউ। পুরো বিষয়টি তদারক করুক আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। আর রাজনৈতিক এ অর্থনৈতিক বিষয় নির্ধারণ করুক এদেশের সরকার। মনে রাখতে হবে করোনা কূটনীতি আসলে জীবন বাঁচানোর কূটনীতি দিনশেষে অর্থনৈতিক কূটনীতিও। এ যুদ্ধে জয়ী হতে হবে আমাদের, নিজেদের স্বার্থেই। নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয় বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন এবং দ্রুততম সময়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন। মনে রাখতে হবে, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়।
লেখক: যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি
Leave a reply