করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে রেলওয়েতে ৩৮টি আন্তঃনগর ট্রেনসহ অন্তত ৭০টি ট্রেন চলাচল বন্ধের ঘোষণা আসছে। আজ-কালের মধ্যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বর্তমানে রেলে সারা দেশে ৩৫৬টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। এসব ট্রেনে গত কয়েকদিন ধরে তুলনামূলক যাত্রী কম হলেও ট্রেনগুলো চলছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে ট্রেন পরিচালনা এ মুহূর্তে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ট্রেন চলাচল বন্ধের কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কমলাপুর রেলস্টেশনসহ নির্ধারিত আরও কিছু স্টেশনে থাকা দোকানপাট রোববার রাত থেকে বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সোমবার বিকালে রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, এটা নিশ্চিত যে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আরও বেশ কয়েকদিন আগেই ট্রেন বন্ধ করে দেয়া উচিত ছিল। কারণ, করোনাভাইরাস প্রাণঘাতী। আমরা যাত্রীদের সেবা দিতে চাই। সেবার বদলে যদি করোনা আক্রান্ত হয়, তাহলে সেটি হবে খুবই দুঃখজনক, যা আমরা করতে পারি না। আমরা সোমবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিছু আন্তঃনগর, মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেন বন্ধ করে দেব। এ জন্য আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই রেলওয়ে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক বরাবর জরুরি ভিত্তিতে পত্র দিয়েছি। পত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী, সোমবার ও মঙ্গলবার সকালের মধ্যে তারা জানিয়ে দেবেন- এই মুহূর্তে কোন কোন ট্রেন বন্ধ করা যায়। তাদের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করেই ট্রেনগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। তবে এর আগে নিশ্চয় সরকারের উচ্চ মহলের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করা হবে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা মেনেই আমরা ট্রেন বন্ধ করার দিকে যাব। এটি একটি সরকারি গণপরিবহন, দেশের যে কোনো দুর্যোগের মধ্যেই ট্রেন চলাচল ছিল। কিন্তু এই করোনা প্রতিরোধে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। এ জন্য দেশবাসীর কাছে আমরা সহযোগিতাও চাই।
মো. নুরুল ইসলাম সুজন আরও বলেন, এই মুহূর্তে ট্রেন চলাচল নিশ্চয় ঝুঁকির। যাত্রীসাধারণের সঙ্গে রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। আমরা চাই সম্মিলিতভাবে এর মোকাবেলা করি। এ জন্য ট্রেন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্টেশনে থাকা দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যেসব স্থানে আমাদের কারখানা রয়েছে, সেখানেও আমরা কাজ সীমিত করব। যারা অগ্রিম টিকিট কেটে নিয়েছে, তাদের টিকিটের সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা হবে। তিনি বলেন, সব ট্রেন এখনই বন্ধ করা হবে না। তবে যেসব ট্রেন চলাচল করবে সেগুলোয় একান্ত প্রয়োজন ছাড়া যেন কেউ ট্রেনে ভ্রমণ না করেন। একান্ত নিরুপায় হয়ে যারা ট্রেনে ভ্রমণ করবেন তারা যেন সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেন। বিভিন্ন স্টেশনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা আছে। সেখান থেকে স্যানিটাইজার হাতে লাগাবেন। থার্মাল স্ক্যানে যেন তাপমাত্রা মেপে নেন।
এ বিষয়ে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক মো. নাসির উদ্দিন সোমবার সন্ধ্যায় জানান, রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ নির্দেশনা এসেছে সোমবার দুপুরে। আমরা নির্দেশনা অনুযায়ী বিকালের মধ্যে কোন কোন ট্রেন এই মুহূর্তে বন্ধ করা যেতে পারে, সেগুলোর একটি লিস্ট/প্রস্তাব পাঠিয়ে দিয়েছি বিকালের দিকে। তিনি বলেন, ৯ জোড়া আন্তঃনগর ট্রেনসহ পূর্বাঞ্চলে মোট ৫৮টি ট্রেন বন্ধের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সব কটি ট্রেনই বন্ধ করে দেয়া যায় কি না, তা দেখা হচ্ছে। তবে আমরা শুরুতে ৫৮টি ট্রেন বন্ধের জন্য বলেছি। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হলে নিশ্চয় সব ট্রেনই বন্ধ করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হবে।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান বাণিজ্যিক দফতর থেকে জানা যায়, মহানগর প্রভাতী-মহানগর গোধূলি, চট্টলা এক্সপ্রেস, কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, এগারোসিন্ধুর প্রভাতী-এগারোসিন্ধুর গোধূলি, জয়ন্তিকা, উপবন, ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস, হাওর এক্সপ্রেস, উদয়ন, পাহাড়িকা এক্সপ্রেসসহ মোট ১৮টি আন্তঃনগর ট্রেন এবং ২৩টি মেইল ও লোকাল ট্রেন এবং কমিউটার ও ডেমুসহ আরও ১৭টি ট্রেন বন্ধের প্রস্তাব সোমবার বিকালে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মিহির কান্তি গুহ সোমবার সন্ধ্যায় জানান, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনামতো আমরা ইতোমধ্যে কোন কোন ট্রেন এ অঞ্চলে এই মুহূর্তে বন্ধ করা যায়, তার একটি তালিকা প্রস্তুত করেছি। ৮টি আন্তঃনগর ট্রেনসহ ১২টি ট্রেন বন্ধের জন্য প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রস্তাবনাটি মঙ্গলবার সকালেই রেলপথ মন্ত্রণালয়ে মেইল করা হবে। এ ছাড়া আমরা মাঠপর্যায় থেকে পুরো বিষয়টি আরও ভালো করে দেখছি। সে ক্ষেত্রে মঙ্গলবার সকালের মধ্যে বন্ধ করে দেয়া ট্রেনের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে আমাদের অঞ্চলে প্রায় প্রতিটি ট্রেনেই যাত্রীর সংখ্যা কমেছে। ফলে সরকারের নির্দেশনা পেলে করোনা প্রতিরোধে দেশের মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে সব ট্রেন বন্ধ করে দেয়ার অনুরোধ জানানো হবে।
মিহির কান্তি গুহ জানান, রাজশাহী-ঢাকা, খুলনা-ঢাকায় চলাচলকারী বনলতা এক্সপ্রেস, ধূমকেতু এক্সপ্রেস, পদ্মা এক্সপ্রেস, সিল্কসিটি এক্সপ্রেস, চিত্রা এক্সপ্রেস, সুন্দরবন এক্সপ্রেস, বেনাপোল এক্সপ্রেসসহ মোট ৮টি আন্তঃনগর ট্রেন এবং আরও ৪টি মেইল ট্রেন বন্ধের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান জানান, করোনা প্রতিরোধে ট্রেন বন্ধের কোনো বিকল্প নেই, কথাটি আমরা বহু আগ থেকেই বলে আসছি। আমরা যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই। কিন্তু এমন অবস্থায় ট্রেনে কিছুতেই যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। উনিশ থেকে বিশ হলেই যে কোনো যাত্রী করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। কারণ, এক একটি ট্রেনে যাত্রীরা গাদাগাদি করে ভ্রমণ করে। তাছা ৫-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত গাদাগাদি অবস্থার মধ্যে যাত্রীরা ভ্রমণ করেন। এটি নিশ্চয় খুবই আতঙ্কের। ফলে আমরা ট্রেন বন্ধের সিদ্ধান্তের দিকে যাচ্ছি। আমরা প্রস্তুত রয়েছি। এখন সরকারের নির্দেশনা পেলেই ট্রেন বন্ধ করা হবে।
রেলপথ সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান আমরা রেলওয়ের উভয় অঞ্চলে প্রস্তাব চেয়েছি। মঙ্গলবার এসব প্রস্তাব আমাদের কাছে আসবে। এরপর বিষয়টি নিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয় তথা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হবে। আমরা যাত্রীদের নিরাপত্তা তথা দেশের মানুষের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ট্রেন বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে। সেই দিকেই আমরা যাচ্ছি। আমরা চাই মানুষ সুস্থ থাকুক। মানুষ নিরাপদ থাকুক। সবাই মিলে এই করোনা প্রতিরোধের যুদ্ধে জয়ী হতে চাই।
Leave a reply