আজকের দিনে যদি সারা পৃথিবীতে চলচ্চিত্র অঙ্গনে খ্যাতিমান কয়েক জন চলচ্চিত্র নির্মাতার তালিকা করা হয় নিঃসন্দেহে স্টিফেন স্পিলবার্গ, জেমস ক্যামেরন, মার্টিন স্কোরসেসে, টিম বার্টন, উডি অ্যালেন, জর্জ লুকাস এ নামগুলো তালিকার সবার উপরে অবস্থান করবে। অথচ গত শতাব্দীতেও যদি কাউকে চলচ্চিত্র অঙ্গনে খ্যাতিমান কয়েক জন চলচ্চিত্র নির্মাতার নাম জিজ্ঞেস করা হতো অনেকের মুখে একজন বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতার নাম উচ্চারিত হতো সন্দেহাতীতভাবে।
তিনি এমনই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র যিনি বাংলা চলচ্চিত্র তো বটেই এমনকি পুরো উপমহাদেশের চলচ্চিত্রকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৪ সালে বিবিসির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তালিকায় তিনি ১৩তম স্থান লাভ করেছিলেন। কিংবদন্তি এ মানুষটি হচ্ছেন সত্যজিৎ রায়। ১৯২১ সালের আজকের এ দিনে (২ মে ১৯২১ – ২৩ এপ্রিল ১৯৯২) তিনি কলকাতা শহরে সাহিত্য ও শিল্প সমাজে খ্যাতনামা রায় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আজ জন্মের ৯৯ বছর পেরিয়ে শত বছরে পা দিলেন। তার বাবা সুকুমার রায় এবং পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী যাদের দুইজনই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি থানার মসূয়া গ্রামে।
এত সমৃদ্ধশালী পরিবারে জন্ম হওয়া সত্ত্বেও সত্যজিৎ রায়ের শৈশব সুখকর হয়নি। মাত্র তিন বছর বয়সে তার পিতৃবিয়োগ ঘটে। মা সুপ্রভা দেবী বহু কষ্টে তাকে বড় করেন। সত্যজিৎ বড় হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি পড়তে যান। যদিও চারুকলার প্রতি সবসময়ই তার দুর্বলতা ছিল। ১৯৪০ সালে মায়ের নির্দেশে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। নিয়মানুযায়ী বিশ্বভারতীতে তার পাঁচ বছর পড়াশোনা করার কথা থাকলেও তার আগেই ১৯৪৩ সালে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং সেখানে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডিজে কিমারে মাত্র ৮০ টাকা বেতনের বিনিময়ে “জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার” হিসেবে যোগ দেন।
চিত্রসজ্জা বা ভিজুয়াল ডিজাইন সত্যজিৎ রায়ের পছন্দের একটি বিষয় ছিল এবং সংস্থাটিতে তিনি বেশ সমাদরেই ছিলেন বলতে হয়। তবে সংস্থাটির ইংরেজ ও ভারতীয় কর্মচারীদের মধ্যে বেশ কিছু বৈষম্যগত কারণে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ চিদানন্দ দাসগুপ্ত ও অন্যান্যদের সঙ্গে মিলে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। সোসাইটির সদস্য হবার সুবাদে তিনি বেশ কিছু বিদেশি চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। তিনি তাদের কাছ থেকে শহরে আসা নতুন মার্কিন চলচ্চিত্রগুলোর খবর নিতেন। এ সময় তিনি নরম্যান ক্লেয়ার নামের রয়েল এয়ার ফোর্সের এক কর্মচারীর সংস্পর্শে আসেন, যিনি তার মতোই চলচ্চিত্র, দাবা ও পাশ্চাত্যের ধ্রুপদী সঙ্গীত পছন্দ করতেন।
১৯৪৯ সালে সত্যজিৎ তার দূরসম্পর্কের বোন ও বহুদিনের বান্ধবী বিজয়া দাসকে বিয়ে করেন। সত্যজিৎ দম্পতির ঘরে ছেলে সন্দীপ রায়ের জন্ম হয়, যিনি নিজেও বর্তমানে একজন প্রথিতযশা চলচ্চিত্র পরিচালক। ১৯৫০ সালে ডিজে কিমার সত্যজিৎকে লন্ডনে তাদের প্রধান কার্যালয়ে কাজ করতে পাঠান। লন্ডনে তিন মাস থাকাকালীন অবস্থায় সত্যজিৎ প্রায় ৯৯টি চলচ্চিত্র দেখেন। এদের মধ্যে ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে (ইতালিয়ান: Ladri di biciclette, “সাইকেল চোর”) তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। পরে সত্যজিৎ বলেছেন যে ওই ছবিটি দেখে সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার সময়েই তিনি ঠিক করেন যে তিনি একজন চলচ্চিত্রকার হবেন।
১৯৫২ সালে তিনি ‘পথের পাঁচালী’ নামক বিখ্যাত চলচ্চিত্রের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান না থাকায় সে সময় ধীরগতিতে এ চলচ্চিত্রটির নির্মাণ কাজ অগ্রসর হচ্ছিল। ১৯৫৫ সালে ছবিটির নির্মাণ সম্পন্ন হয় ও সে বছরই ছবিটিকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর পরই ছবিটি দর্শক সমালোচক সবার নিকট ব্যাপক প্রশংসা লাভ করে ও বহু পুরস্কার জিতে নেয়। ছবিটি নির্মাণের সময় অর্থের বিনিময়ে চিত্রনাট্য বদলের জন্য কোন অনুরোধই সত্যজিৎ রাখেননি। এমনকি ছবিটির একটি সুখী সমাপ্তির (যেখানে ছবির কাহিনীর শেষে অপুর সংসার একটি “উন্নয়ন প্রকল্পে” যোগ দেয়) জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুরোধও তিনি উপেক্ষা করেন।
পুরো ভারত তো বটেই এমনকি ভারতের বাইরেও ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ‘পথের পাঁচালী’ মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ পুরস্কারটি। তার পরের দুটি ছবি ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’ আর ‘পথের পাঁচালী’—এ তিনটি চলচ্চিত্র একত্রে অপু ট্রিলজি হিসেবেই পরিচিত। ‘অপরাজিত’ ছবির সাফল্য সত্যজিৎ রায়কে আন্তর্জাতিক মহলে আরও পরিচিত করে তোলে। ভেনিসে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কারও জেতে ছবিটি। অপু ট্রিলজি শেষ করার আগে সত্যজিৎ রায় আরও দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এর প্রথমটি ছিল ‘পরশপাথর’ নামের হাস্যরসাত্মক একটি ছবি। আর পরেরটি ছিল জমিদারি প্রথার অবক্ষয় নিয়ে নির্মিত ‘জলসাঘর’। এর বাইরে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের ছবিগুলো হচ্ছে ‘দেবী’ (১৯৬০), ‘তিন কন্যা’ (১৯৬১) ও ‘অভিযান’ (১৯৬২)।
১৯৬২ সালে সত্যজিৎ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নামে প্রথম মৌলিক চিত্রনাট্যনির্ভর রঙিন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। দার্জিলিংয়ের এক পাহাড়ি এলাকায় একটি উচ্চবিত্ত পরিবারে কাটানো এক বিকেলের কাহিনী নিয়ে জটিল ও সঙ্গীতনির্ভর এই ছবিটি বানিয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে সত্যজিৎ নির্মাণ করেন ‘চারুলতা’। যেটি ছিল তার কর্মজীবনের সফল ছবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে নির্মিত ছবিটিতে উনিশ শতকের এক নিঃসঙ্গ বাঙালি বধূ চারু ও ঠাকুরপো অমলের প্রতি তার অনুভূতির কাহিনী বাস্তব জীবনের নিরিখে নির্মাণ করা হয়েছে। ‘নায়ক’ (১৯৬৬), ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০), ‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১) ও ‘জন অরণ্য’ (১৯৭৫) ছবিও তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে অগ্রগণ্য।
বাংলা চলচ্চিত্রের বাইরে সত্যজিৎ রায় ১৯৭৭ সালে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ নামের হিন্দি ও উর্দু সংলাপ নির্ভর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এটিই ছিল বাংলা ভাষার বাইরে অন্য ভাষায় নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের প্রথম চলচ্চিত্র। শুধু তা-ই নয়, ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ হচ্ছে সত্যজিৎ রায় নির্মিত সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও তারকাসমৃদ্ধ ছবি। ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন সঞ্জীব কুমার, সাইদ জাফরি, আমজাদ খান, শাবানা আজমি, ভিক্টর ব্যানার্জি ও রিচার্ড অ্যাটেনবরোর মতো তারকা অভিনয়শিল্পীরা। পরবর্তীকালে সত্যজিৎ প্রেমচাঁদের গল্পের ওপর ভিত্তি করে হিন্দি ভাষায় এক ঘণ্টার একটি ছবি বানিয়েছিলেন ‘সদ্গতি’ নামের।
১৯৮৩ সালে ছবির কাজ করার সময় সত্যজিৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এরপর তার কাজের গতি একেবারে কমে আসে। স্বাস্থ্যের অবনতির ফলে ছেলে সন্দ্বীপ রায়ের সহায়তায় ১৯৮৪ সালে সত্যজিৎ রায় ‘ঘরে বাইরে’ ছবিটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন। ১৯৮৭ সালে সত্যজিৎ তার বাবা সুকুমার রায়ের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তার শেষ তিনটি ছবি প্রথম দিকের ছবিগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সংলাপ নির্ভর ছিল। ছবিগুলো হচ্ছে ‘গণশত্রু’ (১৯৮৯), ‘শাখাপ্রশাখা’ (১৯৯০) ও আগন্তুক’ (১৯৯১)। ১৯৯২ সালে হৃদযন্ত্রের জটিলতা নিয়ে সত্যজিৎ হাসপাতালে ভর্তি হন। তারপর সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি তার। ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায় মৃত্যুবরণ করেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের ছিল বহুমুখী সৃজনশীলতা। তার কাজের পরিমাণ বিপুল। তিনি ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’—এই তিনটি চলচ্চিত্রকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। চলচ্চিত্র মাধ্যমে সত্যজিৎ চিত্রনাট্য রচনা, চরিত্রায়ন, সংগীত স্বরলিপি রচনা, চিত্রগ্রহণ, শিল্পনির্দেশনা, সম্পাদনা, শিল্পী-কুশলীদের নামের তালিকা ও প্রচারপত্র নকশা করাসহ নানা কাজ করেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে কল্পকাহিনী লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক।
বর্ণময় কর্মজীবনে তিনি বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি হচ্ছেন দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছিল। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার সত্যজিৎ রায়কে সে দেশের বিশেষ সম্মানসূচক পুরস্কার লেজিওঁ দনরে ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস (অস্কার) তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভারত সরকার তাকে ভারতরত্ন প্রদান করে। মৃত্যুর পর তাকে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়।
কল্পবিজ্ঞানে তার রচিত “ফেলুদা” কিংবা ‘’প্রোফেসর শঙ্কু’ এর মতো কাল্পনিক চরিত্রগুলো আজও বাংলার তরুণ সমাজের হৃদয়ে চির ভাস্বর। আজকে সত্যজিৎ রায়ের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী। জন্মবার্ষিকীর এ দিনে তার প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
Leave a reply