ভয়ংকর রূপে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’। যা ইতিমধ্যে সুপার সাইক্লোনে পরিণত। যে কারণে মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়ার ঘূর্ণিঝড় একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা পৃথিবীতে তাপের ভারসাম্য রক্ষা করে। পৃথিবীতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৮০ টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এর অধিকাংশই সমুদ্রে মিলিয়ে যায়, কিন্তু যে অল্প সংখ্যক ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে তা অনেক সময় ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করে।
সমুদ্র উপকূলে অবস্থানের কারণে ঝড়-সাইক্লোন-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় পতিত হয় বাংলাদেশ। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ে অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ও পরে বাংলাদেশে যেসব ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে, তার মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলে বয়ে যাওয়া ঝড়কে সর্বাধিক প্রলয়ঙ্ককরী হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
জেনে নিই ইতিহাসের কয়েকটি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের কথা।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়
বাংলাদেশের মধ্যে ঘটে যাওয়া স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অন্যতম ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়। ঝড়টি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে সংঘটিত হয়। পরিসংখ্যান বলছে, এ ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হয়।
ঝড়টি ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত করে। এই ঘূর্ণিঝড়ে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে। প্রায় ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষ নিহতের পাশাপাশি প্রায় ১ কোটি মানুষ সর্বস্ব হারায়। সর্বাধিক নিহত হয় সন্দ্বীপ, মহেশখালী, হাতিয়া দ্বীপে। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বৃদ্ধ ও শিশু।
নিহতের সংখ্যা আরও কম হতে পারত। ধারণা করা হয়- প্রায় ২০ লাখ লোক আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে যার যার বাড়িতে অবস্থানের কারণে আক্রান্ত হয়। সে সময় প্রায় ১০ লক্ষ ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ১ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়ে।
বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড়
পৃথিবীর ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাসে ষষ্ঠ স্থান দখল করে আছে বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড়। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়টির জন্য ১৮৭৬ সালের ৩১ অক্টোবর দিনটি স্মরণীয়। আনুমানিক ২ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে এই ঘূর্ণিঝড়ে। দুর্যোগ পরবর্তী মহামারী এবং দুর্ভিক্ষে আরও বহু মানুষের মৃত্যু হয়। ঝড়টি ‘দ্য গ্রেট বাকেরগঞ্জ ১৮৭৬’ নামেও পরিচিত। অক্টোবর মাসের শেষ দিনটি এ সময় মেঘনার মোহনা এবং চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালী উপকূলে তীব্র ঝড়ো জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবন সংঘটিত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে বাকেরগঞ্জের নিম্নাঞ্চল সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত হয়ে যায়।
ভোলার ঘূর্ণিঝড়
১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে এ ঘূর্ণিঝড়। এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। এটি ছিল সিম্পসন স্কেলে ‘ক্যাটাগরি ৩’ মাত্রার ঘূর্ণিঝড়। এ ঝড়ের কারণে প্রায় ৫ লাখ ব্যক্তি প্রাণ হারায় বলে খবরে প্রকাশ হয়। ঘূর্ণিঝড়টির গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে গিয়ে পৌঁছায় এবং রাতে উপকূলে আঘাত হানে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা। ওই উপজেলার ১ লাখ ৬৭ হাজার অধিবাসীর মধ্যে ৭৭ হাজার জন প্রাণ হারায়।
ঘূর্ণিঝড় সিডর
ঘূর্ণিঝড় সিডর ও এর ভয়াবহতার কথা জানেন না এমন ব্যক্তি নেই একজনও। ২০০৭ সালের ১০ নভেম্বরে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি সমুদ্রে ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টি হয়। বঙ্গোপসাগরের এটি দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে। ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার পর বাংলাদেশের পাথরঘাটায় বালেশ্বর নদীর কাছে উপকূল অতিক্রম করে ঝড়টি। ঝড়টি ২২৩ কিলোমিটার বেগে ১৫-২০ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসে নিয়ে আসে। রেডক্রসের হিসাব অনুযায়ী সিডরে মারা গেছে ১০ হাজার মানুষ । তবে সরকারিভাবে এ সংখ্যা ৬ ছয় হাজার বলা হয়েছে।
এ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ঝড়ো হাওয়াসহ বিপুল পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়। এক রিপোর্টে প্রকাশ- সিডরে সে সময় সুন্দরবনের বেশকিছু হরিণসহ আরও অনেক বন্য প্রাণির মারা যায়। প্রায় ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস এবং ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। এছাড়াও প্রায় ২ লাখ ৪২ হাজার গৃহপালিত পশু এবং হাঁস-মুরগি মারা যায়।
ঘূর্ণিঝড় আইলা
২০০৯ সালে উত্তর ভারত মহাসাগরে জন্ম নেয়া ঘূর্ণিঝড়টির নাম আইলা। ঘূর্ণিঝড়টি ২৫ মে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানে। প্রায় ৩০০ কিলোমিটার ব্যাস নিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি ৭০-৯০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। সিডর থেকে আইলায় ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কম হয়।
ঘূর্ণিঝড় মহাসেন
২০১৩ সালের মে মাসের শুরুর দিকে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণাংশে উৎপত্তি মহাসেন নামের ঘূর্ণিঝড়টির। ১৪ মে এটি উত্তর-পূর্বাংশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ঝড়টি শ্রীলংকায় আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে শ্রীলঙ্কায় বন্যা হয়। এছাড়া ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশেও বেশকিছু প্রাণহানি ও ক্ষতিক্ষতি হয় মহাসেনের প্রভাবে। ঝড়টির নাম প্রথমে মহাসেন দেয়া হলেও পরে নামটি নিয়ে বির্তক ওঠে শ্রীলংকার জাতীয়তাবাদী এবং সরকারী কর্মকর্তাদের মাঝে। দেশটির তৃতীয় শতকের সিংহল রাজার নাম থেকে মহাসেন নামকরণ হয় বলে জানা গেছে। পরে শ্রীলংকার সংবাদমাধ্যমে মহাসেন নামহীন ঝড় বলে বর্ণনা করা হয়।
ঘূর্ণিঝড় মোরা
ঘূর্ণিঝড় মোরা ২০১৭ সালের মে মাসের শেষের দিকে যে ঘুর্ণিঝড়টির উৎপত্তি তার নাম দেয়া হয় ‘মোরা’। আবহাওয়া অধিদফতর চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজার উপকূলকে ১০ নম্বর মহা বিপৎসংকেত এবং মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৮ নম্বর সংকেত দেখাতে বলে। ৩০ মে ২০১৭ মঙ্গলবার সকাল পৌনে ৬টার দিকে কক্সবাজারের টেকনাফে ১৩৫ কিমি বেগে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’। ‘মোরা’ একটি থাই শব্দ। এর ইংরেজি হচ্ছে- ‘স্টার অব দ্য সি’। বাংলায় ‘সাগরের তারা’। এ ঘুর্ণিঝড়ে আক্রান্ত জেলাসমূহে হাজার হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। কক্সবাজারে বিদ্যুৎব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। টেকনাফের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জমির ফসল এবং লবন চাষীদের জমাকৃত লবন নষ্ট হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়টির কারণে শ্রীলঙ্কায় প্রবল বৃষ্টিপাতে বন্যা এবং ভূমিধ্বস দেখা দেয়। এর ফলে প্রায় ১৮০ জন লোক মারা যায় বলে আর্ন্তজাতিক প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়।
ফণী (২০১৯)
প্রবলমাত্রার ঘূর্ণিঝড় ফণী ভারতের ওডিশা রাজ্যে আঘাত হানা একটি শক্তিশালী গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড় ‘ফণীর’ নাম দিয়েছে বাংলাদেশ, এর অর্থ সাপ (ফণা আছে যার)। এটি ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ভারত মহাসাগরের মৌসুমের দ্বিতীয় নামাঙ্কিত ঝড় এবং প্রথম অত্যন্ত তীব্র ঘূর্ণিঝড়। ফণী ২৬ এপ্রিল ভারতীয় মহাসাগরে সুমাত্রার পশ্চিমে গঠিত একটি ক্রান্তীয় নিম্নচাপ থেকে সৃষ্টি হয়। শনিবার (৪মে) সকালে সাতক্ষীরা, যশোর ও খুলনা অঞ্চল এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রবেশ করে ঝড়টি। ফণীর প্রভাবে ও আঘাতে বাংলাদেশে মোট ১৮ জনের মৃত্যু হয়। নিহতরা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, নোয়াখালী, মাদারীপুর, ভোলা, বরগুনা, বাগেরহাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা।
বুলবুল (২০১৯)
এই তো সবে মাস ছয়েক হলো। গত ৯ নভেম্বর বাংলাদেশ উপকূলের উপর কয়েক ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালায় বুলবুল। ঘূর্ণিঝড় বুলবুল চলমান সময়ে আট জন ব্যক্তির মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যায়।ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে ৯, ১১ ও ১২ নভেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণীর পরীক্ষা, সকল জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়
১৯৬০ সালের ৩১শে অক্টোবরের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ ১৪৯ জন নিহত হয়। ৬.১ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস ছিল।
১৯৬০ সালের ৩১শে অক্টোবর চট্টগ্রামে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঘূর্ণিঝড়
১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামে ১লা অক্টোবর ২০-২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঘূর্ণিঝড়
২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস এর পূর্বাভাস দেওয়া হলেও পরে তা বার্মার উপকূলে আঘাত হানে। মিয়ানমারে এর প্রভাবে বহু ক্ষতি হয়।
২০১৫ সালের ৩০শে জুলাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে ৫-৭ ফুট উচ্চতার ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’
২০১৬ সালের ২১শে মে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূলে ৪-৫ ফুট উচ্চতার ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’
Leave a reply