রংপুর প্রতিনিধি:
ট্রাকের কেবিনে ১৬ ঘণ্টা থাকার পর ময়নাতদন্ত হয়ে দুইদিন তিস্তা নদীতে ভেসে পুলিশের সহযোগিতায় হয়েছে দাফন। রংপুরে এক গার্মেন্টস কর্মীর মরদেহের সাথে সাথে এমনই পৈশাচিকতা হয়েছে।
পুলিশ, পরিবার এবং ট্রাক চালক ও হেলপার সূত্র মতে, গত ২১ মে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে এগারোটায় টঙ্গীর হারিকেন এলাকা থেকে মাহমুদা আক্তার মৌসুমী নামের গার্মেন্টস কর্মীকে রংপুরে বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্য ট্রাকের কেবিনে উঠায় চালক আজিজুল ও হেলপার রতন। লালমনিরহাটের বুড়িমারীর শফিকুল ইসলাম নামের আরেক ড্রাইভার তাদের ওই তরুণীকে বাড়িতে পৌঁছে দেবার অনুরোধ জানায়। এরপর তাকে নিয়ে ঢাকায় গাউছিয়া হয়ে মুন্সীর পাম্পে গিয়ে ট্রাকে গরুর মশারি ভর্তি করে রংপুরের উদ্দেশে রওনা দেয় তারা। পথিমধ্যে আব্দুল্লাহপুরে এসে ওই ট্রাকে ওঠে চালক আজিজুলের ভাতিজা বদি মিয়া।
কিন্তু চান্দুরা এলাকা পার হওয়ার পর ভাতিজা বদি জানায় যে মেয়েটি মারা গেছে। তারপর ২২ মে শুক্রবার সকাল সাতটায় রংপুর ক্যাডেট কলেজের সামনে এসে ট্রাকটি দাঁড় করায় চালক আজিজুল। এরই মধ্যে লাশটি নিয়ে শুরু হয় নজীরবিহীন নিষ্ঠুরতা। মেয়েটির পৈত্রিক নিবাস লালমনিরহাটের বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিশাত ও ফোন কলে তুলে দেয়া অপর চালক শফিকুল এবং ট্রাকটির চালক আজিজুল, হেলপার রতন ও বদি মিয়া বিষয়টি পুলিশকে অবহিত না করেই বুড়িমারীতে মেয়েটির পিতা মোস্তফার সাথে সমঝোতার চেষ্টা করে।
ট্রাক চালক আজিজুল ইসলাম ও হেলপার রতন জানান, তরুণীর পিতা মোস্তফা রংপুরে এসে মেয়েকে দেখে জানায় যে তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ফলে তিনি লাশ না নিয়েই পাটগ্রামে ফিরে যান। পরে বিষয়টি সন্ধ্যায় পুলিশ জানার পর থেকেই সেখানে পুলিশের পাহারা বসানো হয় এবং ড্রাইভার ও হেলপারকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করে পুলিশ। এরই মধ্যে ট্রাক থেকে গরুর মশারিগুলো নামিয়ে নেয়ার জন্য রংপুর মহানগরীর স্টেশন রোডের খান বেডিংয়ের মালিক অন্য একটি ট্রাক নিয়ে আসে। রাত সাড়ে ১০টায় সেখানে সাংবাদিকের ক্যামেরা দেখে দ্রুত গতিতে পালিয়ে যায় দ্বিতীয় ট্রাকটি।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের তাজহাট থানার ওসি রোকন উদ দৌলা জানান, আমরা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পারি তরুণীর পিতা লাশটি গ্রহন করতে অস্বীকার করায় ২২ তারিখ সন্ধায় খবর দেয়া হয় পুলিশকে। আমরা সেখানে পাহারা বসাই। এবং লাশ পোস্ট মর্টেমের জন্য রাত পৌনে ১২টায় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালের মর্গে পাঠাই। পরের দিন ২৩ মে ময়নাতদন্ত শেষে লাশটি তার পিতা মোস্তফার হাতে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা হস্তান্তর করি। একই সাথে মেয়েটির নমুনা সংগ্রহ করে পিসিআর ল্যাবে পাঠাই।
কিন্তু ১৬ ঘণ্টা কেবিনে থাকার পর ময়নাতদন্ত হলেও লাশ নিয়ে বিপাকে পড়েন তরুণীর পিতা মোস্তফা। স্থানীয় বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নিশাত ওই লাশ বাড়িতে আনতে নিষেধ করে অন্যত্র দাফনের নির্দেশ দেন। অভিযোগ রয়েছে, বাড়িতে আনলে তাকে গ্রাম ছাড়া করার হুমকি দেয়া হয়। কি করবেন বুঝে উঠতে না পারায় চেয়ারম্যানই তাকে একটি এ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে দিয়ে ৫ হাজার টাকা দিয়ে লাশটি অন্য কোথাও দাফন করে আসার পরামর্শ দেন। এ্যাম্বুলেন্স চালককে বলা হয়, আনজুমানে মফিদুল ইসলাম এ লাশটি দিয়ে আসতে।
কিন্তু এ্যাম্বুলেন্স চালক লাশটি আনজুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে না দিয়ে গঙ্গাচড়ার শেখ হাসিনা তিস্তা সেতুর পার্শ্বে তিস্তা নদীতে ফেলে দেয়। ২৪ মে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিশখোচা ইউনিয়নের চরগোবর ঘাট চরে স্থানীয়রা সাদা কাফনে একটি লাশ ভেসে থাকতে দেখে পুলিশে খবর দেয়।
আদিতমারী থানার ওসি সাইফুল ইসলাম জানান, সন্ধার আগে স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে যাই চরগোবরার চরে। গিয়ে দেখতে পাই বাংলাদেশ পুলিশ লেখা একটি কাফনের কাপড়ে মোড়ানো এক তরুণীর মরদেহ। খুলে দেখতে পাই ময়নাতদন্ত করা লাশটি। নিয়মানুযায়ী মরদেহটি দাফন হওয়ার কথা। কিন্তু নদীতে কেন বিষয়টি সাথে সাথেই এসপিকে জানানো হয়। রাতেই খুঁজে বের করা হয় বুড়িমারির আমবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা মৌসুমীর পিতা মোস্তফাকে। তাকে থানায় নিয়ে এসে মরদেহ শনাক্ত করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে মোস্তফা জানান, স্থানীয় চেয়ারম্যান নিশাত হুমকি দিয়েছে লাশ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাবে না। চেয়ারম্যান বলেছে তোমার মেয়ের করোনা আছে নয় তাকে ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে। তাকে গ্রামে দাফন করা যাবে না। আনজুমানে মফিজুল ইসলামে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সেখানে লাশ দিয়ে তারপর বাড়ি আসো। ওসি জানান, এরই মধ্যে আমরা রিপোর্ট পাই তরুণীর করোনা নেগেটিভে এসেছে। বিষয়টি এসপিসহ জেলা প্রশাসনকে জানানো হলে পাটগ্রামের ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, ওসিসহ প্রশাসনের কর্মর্তাদের উপস্থিতিতে নিজ বাড়িতে লাশ দাফন করা হয়। ওসি আরও জানান, চেয়ারম্যান সব সময় মোবাইলে কথা বলতো মোস্তফার সাথে। সব নম্বর ট্রাকিং শুরু করা হয়েছে।
লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা ঘটনার বর্ননা দিয়ে জানান, আদিতমারীর ওসি আমাকে ফোন করার সাথে সাথেই আমার মাথায় আসে রংপুর ক্যাডেট কলেজের সামনে ট্রাকের কেবিনে থাকা তরুণীর মরদেহের বিষয়টি। সাথে সাথে আমি বিষয়টি রংপুর মেটোপুলিশের সাথে যোগাযোগ করে পাটগ্রাম থানার ওসিকে নির্দশ দেই খোঁজ নিতে। তিনি খোঁজ নিয়ে জানান মর্গ থেকে লাশ হস্তান্তর করা হলেও সেটি পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়নি। পরে আমরা লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করি।
তিনি জানান, পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষায় মেয়েটির করোনা সন্দেহ এসেছে নেগেটিভ। বাকী থাকলো ধর্ষণের ঘটনা। পুরো ঘটনাতেই ঘুড়ে ফিরে আসছে স্থানীয় চেয়ারম্যান নিশাতের নাম। তিনিই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দাফন করতে বাঁধা দিয়েছিলেন। সেকারণে অসহায় ছিল পরিবার। পুরো বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা। তিনি জানান, এ ঘটনায় ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করছে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন। যে ট্রাকের কেবিনে ছিল লাশ, সেটির গায়ে খাদ্য পরিবহনের কথা লেখা থাকলেও বহন করা হচ্ছিল গরুর মশারি।
Leave a reply