যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের আলমারির দড়িতে প্রায় দুই শতাব্দী ধরে ঝুলে ছিল একটি কঙ্কাল। তবে আদালত রায়ে ওভাবে ঝুলিয়ে রাখতে বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছিল আরও ভয়ঙ্কর কিছু।
রায়েই বলা হয়েছিল, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর ওই ব্যক্তির চামড়াও তুলে নিতে হবে। চামড়া তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ডাঃ রিচার্ড স্মিথকে। হতভাগ্যের শরীর থেকে তুলে নেয়া এক টুকরো চামড়ায় ডাক্তার স্মিথ লেখেন-
“জন হরউডের পাকা করা চামড়া, এলিজা বালসামকে হত্যার দায়ে ১৮২১ সালে ব্রিস্টল হাতপাতালে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।”
কয়লা খনির শ্রমিক থমাস হরউডের সন্তান জন হরউডের জন্ম ১৮০৩ সালে, ব্রিস্টলের শহরতলীতে। থমাসের দশ সন্তানের মধ্যে জন ছিল সবার ছোট। পরিবারের সবাই কয়লা খনির কাজের সঙ্গে জড়িত।
খনিতে দু’বছর কাজ করার এক সময় এলিজা বালসাম নামে এক তরুণীর প্রেমে মোহাবিষ্ট হয় জন। এলিজাকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ অনুসরণ করতে গিয়ে খনির চাকরিটি হারায় সে।
এলিজা তাকে পছন্দ করত কিনা, তা জানা যায়নি। তবে প্রেম-ভালোবাসায় অপর পক্ষের সম্মতির বিষয়টি যে জন হরউড পরোয়া করেনি সে বিষয়টি নিশ্চিত। মোহের বশে একরকম অন্ধ হয়ে এলিজাকে উত্যক্ত করতে লাগলো সে।
১৮২১ সালে জানুয়ারি মাসের এক রাতে এলিজাকে দুই ছেলের সঙ্গে দেখে পাথর ছুড়ে মারে জন। পাথরটি এলিজার মাথার ডান পাশে গিয়ে আঘাত করে। প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ব্রিস্টল হাসপাতালে ভর্তি হয় এলিজা।
ব্রিস্টল আর্কাইভে রাখা ডাঃ এডওয়ার্ড ইস্টলিনের ডায়রি হতে জানা যায়, ঘটনার দিন পাঁচেক পর এলিজা বালসামের আঘাতের স্থানে বড় ধরনের সংক্রমণ দেখা দেয়। এই ফোঁড়ার সংক্রমণ থেকে অবশেষে এলিজার মৃত্যু ঘটে।
এলিজা হত্যার ঘটনায় আদালতে বিচার শুরু হয় ১১ এপ্রিল ১৮২১ সালে। দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় জন হরউডকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়। কিন্তু আদালত এখানেই থামেননি। ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে তার চামড়া তুলে নেওয়ার ভার দেন ডাঃ রিচার্ড স্মিথকে।
অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি সত্যিই জনের চামড়া তুলে ফেলা হয়। তবে মেডিকেল ব্যর্জের সঙ্গে তা পুড়িয়ে ফেলার কথা থাকলেও ডাক্তার স্মিথ তা সংরক্ষণ করেন। পুরো বিচার, রায়, এবং রায় কার্যকরসহ-এ মামলা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাদি ‘হরউড বুক’ শীর্ষক বইয়ের প্রচ্ছদ তৈরিতে ডাঃ স্মিথ সংরক্ষণ করা চামড়া ব্যবহার করেছিলেন। হরউডের দেহটি রেখে দেওয়া হয়েছিল ব্যবচ্ছেদের কাজে ব্যবহারের জন্য। আর কঙ্কালটি ডাঃ স্মিথ তার মৃত্যু অবধি নিজের বাসায় রেখেছিলেন।
বইটির প্রচ্ছদে একটি ফাঁসি কাষ্ঠের মটিফ, এবং আড়াআড়িভাবে রাখা হাড়ের ছবি খোদাই করা হয়েছে। আর লেখা আছে, ‘কুটিস ভেরা জোহানিস হরউড’ বা ‘দ্য স্কিন অব হরউড’, অথবা ‘হরউডের চামড়া’। বইটি ব্রিস্টল আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে।
এমন ভয়ঙ্কর শাস্তির কথা সচরাচর শোনা যায় না, বর্তমানে তো একদমই না। কিন্তু উনিশ শতকে যুক্তরাজ্যে তো আর পুরোপুরি মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থা ছিল না। শিল্প বিপ্লবের ভর করে গোটা পৃথিবীতে ব্রিটিশদের জয় জয়কার ছিল তখন। কেন এমন আদেশ দেয়া হয়েছিল? কারণটি ব্রিস্টল আর্কাইভেই রয়েছে:
“আঠারো শতকের শুরু থেকে খুনের পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল। এ থেকে উত্তরণে মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরিতে সক্ষম ভয়ঙ্কর কোনো শাস্তির বিধান রাখতে পার্লামেন্ট আদেশ জারি করেছিল। ১৭৫২ সালের ইস্টারের আগে একটি আইন পাস করা হয়, তাতে খুনের দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের লাশ ব্যবচ্ছেদের জন্য ডাক্তারদের হাতে তুলে দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছিল।”
যাই হোক, অবশেষে মৃত্যুর ঠিক ১৯০ বছর পর ২০১১ সালে জন হরউডকে ব্রিস্টলে সমাহিত করা হয়। তার ভাইয়ের বংশধর ম্যারি হ্যালিওয়েল এই শেষকৃত্যের আয়োজন করেন।
যমুনা অনলাইন: এফএইচ
Leave a reply