কামরানের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের গল্প

|

সিলেট শহর যখন সিটি করপোরেশন হিসেবে স্বীকৃত লাভ করল তখন পৌর চেয়ারম্যান থেকে ভারপ্রাপ্ত মেয়র, এরপর নির্বাচিত মেয়র হিসেবে যার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তিনি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। সিলেট নগরের জন্ম তখন থেকেই সিলেটবাসীর কাছ থেকে পেয়েছেন নগরপিতার পরিচয়টি। এরপর দশ বছর নগরপিতার আসনে বসে সিলেট সিটি করপোরেশনের মানুষের সাথে ছিলেন। নগরের সেবা করার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব ছাড়ার পরও মানুষের সুখে-দুঃখের সাথী ছিলেন তিনি। তাই হয়ত মানুষের কাছে ‘সাবেক’ হননি। নামের পাশে থেকে যায় ‘মেয়র কামরান’।

সেই সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য বদর উদ্দিন আহমদ কামরান সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন। রোববার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র। করোনাভাইরাসের কাছে হার মেনে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের টানা ১৭ বছরের এই সভাপতির চলে যাওয়াটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না সিলেটবাসী।

তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। এসময় পরিবারের সবাইকে ধৈর্য ধরতে আহ্বান জানান তিনি।

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের হাত ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। ছাত্র অবস্থাতেই কামরান ১৯৬৮-৬৯ এর উত্তাল সময়ে মিছিল যাওয়ার শুরু করেন। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া অবস্থাতেই ১৯৭৩ সালে কামরান সিলেট পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। সেই থেকে রাজনীতির মাঠে পথচলা। ১৯৭৭ সালে আবার কমিশনার নির্বাচিত হন। একের পর এক সাফল্যের হাত ধরে ১৯৯৫ সালে তিনি পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর মানুষের আস্থার প্রতিদান দিয়ে জনপ্রতিনিধির অগ্নিপরীক্ষায় বরাবরই উতরে গেছেন তিনি।

২০০২ সালে যখন সিলেট পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হয়, তখন ‘বিলুপ্ত’ পৌরসভার চেয়ারম্যান বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে নবগঠিত সিলেট সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র করা হয়। এরপর ২০০৩ সালের নির্বাচনে তিনি সিলেটের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। এক এগারোর সময় কারাগারে থেকেও কামরান দ্বিতীয় বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন। সে সময় বিএনপির তৎকালীন প্রার্থী বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এম এ হককে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। নিজ দল ক্ষমতার বাইরে থাকা স্বত্বেও অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দুইবার মেয়র পদে নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েন তিনি।

কিন্তু ২০১৩ সালের নির্বাচনে নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে হেরে যান তিনি। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনেও আরিফের কাছে হারেন কামরান। কিন্তু আশাহত হলেও ভেঙে পড়েননি। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে থেকে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিপদে সবসময় পাশে থেকেছেন কামরান। সিলেট মহানগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েও বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের জন্য গোটা সিলেট বিভাগ চষে বেড়িয়েছেন কামরান।

করোনা পরিস্থিতিতে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান কামরান। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যান অসহায় মানুষের সহায়তায়।

রাজনীতিবিদ কামরান এক সময় সংস্কৃতিচর্চায় ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। শিশু কিশোর সংগঠন চাঁদের হাটের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। শৈশবের দুরন্ত সময়ে খেলেছেন ক্রিকেট-ফুটবলও। শৈশব ও কৈশোরে বাইসাইকেল ছিল কামরানের নিত্য সঙ্গি। ছোটবেলায় ঘুড়ি ওড়ানোতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন কামরান।

বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ১৯৬৮ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পর দীর্ঘদিন সিলেট শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি পদে ছিলেন।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিলে কামরানকে বাদ দিয়ে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয় মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদকে। আর কামরানকে করা হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। এর আগের মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির পাশাপাশি দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন কামরান।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply