সীমান্তে চীন-ভারতের মধ্যে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব সংঘর্ষগুলো বেশিরভাগ সিকিম, অরুণাচল ও সবশেষে লাদাখে হয়েছে। এসব রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে দুই দেশের সেনাসদস্যদের ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
১৯৬২ সালের পর ১৯৬৭ সালে চীন-ভারতের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ৪৫ বছর আগে ১৯৭৫ সালে দুদেশের মধ্যে শেষবারের মতো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটেছিলো। আর সবশেষ প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে সংঘর্ষ হয় গতকাল (১৫ জুন)।
১৯৬২ সালে অরুণাচলে চীন-ভারত সংঘর্ষ:
১৯৬২ সালে অরুণাচলে চীন ও ভারতের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিলো। অরুণাচলে তুলুঙ লা থেকে দক্ষিণে সে লা গিরিপথে নিজেদের অবস্থান হারালে চীনা বাহিনী ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে। সে সময় অরুণাচলের একটি অংশ দখল করে নিয়েছিলো চীন। সীমান্ত যুদ্ধের মূল কারণ ছিলো আকসাই চীন এবং অরুণাচলের সার্বভৌমত্ব নিয়ে পারস্পরিক বিবাদ। দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ অধিকাংশ সময়েই সমতল থেকে অধিক উচ্চস্থানে সংঘটিত হয়েছিলো। আকসাই চীন ৫ হাজার মিটার উচ্চতায় এক সল্ট প্লেটের মরুভূমি। অরুণাচল প্রদেশে ৭ হাজার মিটারেরও অধিক উচ্চতায় কয়েকটি গিরিপথ আছে। সে সময় চীনা সেনারা অঞ্চলটির এক বৃহৎ স্থান দখল করে নিয়েছিলো।
বলা হচ্ছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালীয় ক্যাম্পেইনের মতো এই যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই বহু সৈনিক শত্রুর আক্রমণের পরিবর্তে পরিবেশের প্রতিকূলতার জন্যে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
১৯৬৭ সালে সিকিমে নাথু লা এবং চো-লায়ে চীন-ভারত সংঘর্ষ:
১৯৬৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সিকিমের নাথু লা ও চো-লায়ের ভারতীয় সেনা চৌকি লক্ষ্য করে আচমকাই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার ওপার থেকে হামলা করে চীনা বাহিনী। ভারি গোলা বর্ষণের প্রাথমিক আকস্মিকতা কাটিয়ে পাল্টা জবাব দিতে থাকে ভারতীয় সেনা। টানা পাঁচদিন ধরে সংঘর্ষ চলে। কিন্তু নাথু লা-তে অবস্থানগত সুবিধা ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে। পাল্টা হামলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে থাকে চীনের দিকে। শেষ পর্যন্ত পিছু হটে চীনা বাহিনী।
১৯৬২ যুদ্ধের পরে ভারত-চীনের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ এটাই। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি, ওই পাঁচ দিনের সংঘর্ষে অন্তত ৪০০ চীনা সেনা সদস্যের মৃত্যু হয়েছিলো। সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে সংঘর্ষে ইতি দিতে বাধ্য হয় চীন।
১৯৭৫ সালে অরুণাচলে চীন-ভারত সংঘর্ষ:
১৯৭৫ সালের ২০ অক্টোবর অরুণাচলে চীন-ভারতের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রুটিন মেনেই সেদিন ভোর থেকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা ধরে টহলে বেরিয়েছিলেন আসাম রাইফেলসের ২৫ ব্যাটালিয়নের জওয়ানরা। টহলের রাস্তায় শেষ জনপদ তাওয়াঙ জেলার থিঙবু-র মাগো গ্রাম।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার ২৪০ মিটার উচ্চতায় থাকা মাগো গ্রাম ছেড়ে টহল দল এগিয়ে যায় আরও ওপরে। হিমালয়ের কোলে দুর্গম ও প্রত্যন্ত গিরিবর্ত্ম তুলুঙ-লায়ের দিকে। ভারতীয় ভূখণ্ড রক্ষায় মাগোর মতোই কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ৪ হাজার ৮৬৩ মিটার উঁচুতে থাকা ওই গিরিপথ।
প্রায় ১৫ দিন পরে সেনার একটি তার বার্তা প্রকাশ্যে আসে। জানা যায়, সে দিন তুলুঙ-লাতে পৌঁছনোর আগেই প্রায় ৫০০ মিটার দূরে চীনা বাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলি বৃষ্টির মুখোমুখি হয় ভারতীয় টহল বাহিনী। গোপনে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে ওই গিরিপথের একটি দুর্গম অংশ দিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করে চীনা বাহিনীর পুরো একটি প্লাটুন।
রাতারাতি পাথরের দেয়াল খাড়া করে তার পেছন থেকে ভারতীয় টহল বাহিনীকে লক্ষ্য করে হামলা চালায় চীনা বাহিনী। ওই দিনের সংঘর্ষে মারা যান আসাম রাইফেলসের চারজন জওয়ান। এর পরেও টহল বাহিনী চীনা অনুপ্রবেশকারীদের পিছু হটতে বাধ্য করে। বলা হচ্ছে, যদিও সে দিন চীনা বাহিনী অবস্থানগতভাবে অনেক সুবিধাজনক জায়গায় ছিলো।
গণমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত-চীনের মধ্যে শেষ সংঘর্ষ স্থলে গত ৪৫ বছরে ওইসব এলাকায় মজবুত করা হয় সেনা অবস্থান। ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর যৌথ নজরদারি চলছে সবসময়।
চীন-ভারতের সর্বশেষ সংঘর্ষ ২০২০ সালের ১৫ জুন:
লাদাখের গালোয়ান উপত্যাকায় চীন-ভারতের মধ্যে সর্বশেষ সংঘর্ষ হয়। এতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক কর্নেল ও দুই সেনা সদস্য নিহত হয়। ভারতীয় সেনা সদস্য নিহত হওয়ার পাশাপাশি দুই দেশের সেনা সদস্যরা আহত হয়েছেন। সীমান্ত নিয়ে সামরিক পর্যায়ের বৈঠকের কয়েক সপ্তাহ পরে এমন বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলো।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, কয়েক দশক পর পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
সূত্র: উইকিপিডিয়া ও আনন্দবাজার পত্রিকা
Leave a reply