মহামারি করোনায় শীর্ষ সংক্রমণ ও মৃত্যু, অর্থনীতির বেহাল দশা এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সময়টা ভালো যাচ্ছে না মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের।
এর মধ্যেই তার দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছেন সাবেক ঘনিষ্ঠ সহচর জন বোল্টন। অপ্রকাশিত বইতে বোল্টন ট্রাম্প প্রশাসন বিশেষ করে ট্রাম্পের এমন সব তথ্য প্রকাশ করেছেন যা রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।
বইটিতে বোল্টন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তুলে ধরেছেন একজন অজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে। যার সাধারণ ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ে জ্ঞানের অভাব রয়েছে ও যিনি বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত নেন নির্বাচনে আবার জিতে আসতে হবে এ তাড়না থেকে। খবর সিএনএন ও বিবিসি বাংলা।
‘দ্য রুম হোয়্যার ইট হ্যাপেনড’ নামের অপ্রকাশিত এ বইয়ের কিছু অংশ মার্কিন সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেছে। যাতে দেখা যায় বোল্টন প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে মারাত্মক কিছু দাবি করেছেন।
এমনকি ট্রাম্পের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কাজে প্রশাসনের অনেকেই তার পেছনে হাসাহাসি করেছেন বলে লিখেছেন তিনি।
ট্রাম্পের সমালোচকরা অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন ইমপিচমেন্ট (অভিশংসন) শুনানির সময় বোল্টন কেন এসব নিয়ে মুখ খোলেনি?
বিশেষ করে যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই সে সময় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে তার সাবেক এ শীর্ষ উপদেষ্টাকে অদক্ষ ও একজন বোরিং বোকা বুড়ো বলে মন্তব্য করেছিলেন।
হোয়াইট হাউস বইটির প্রকাশ বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু মার্কিন সংবাদমাধ্যম বইয়ের অগ্রিম কপি হাতে পেয়েছে। অনেক কাগজ এ বইয়ের অংশবিশেষ ছাপতেও শুরু করেছে। সেখান থেকেই তুলে ধরা হল ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জন বোল্টনের আনা সবচেয়ে মারাত্মক ১০টি অভিযোগ।
নির্বাচনে আবার জয়লাভের জন্য চীনের সাহায্য চেয়েছিলেন: বইয়ে বোল্টন গত বছর জাপানে জি-২০ সম্মেলনের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে এক বৈঠকের কথা উল্লেখ করেছেন।
ট্রাম্প হঠাৎ কায়দা করে আলোচনা ঘুরিয়ে ফেললেন আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে। চীনের বিরাট অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিকে ইঙ্গিত করলেন ও শিকে অনুরোধ করলেন তার জেতা তিনি যেন নিশ্চিত করেন।
বোল্টন আরও বলেন, কৃষকরা কত গুরুত্বপূর্ণ সেটার ওপর তিনি জোর দেন ও নির্বাচনে সুবিধা পাওয়ার জন্য চীনে সয়াবিন ও গমের বিক্রি বাড়িয়ে দেন।
আমেরিকায় মিডওয়েস্টের রাজ্যগুলোতে কৃষি অন্যতম প্রধান অর্থনীতি। এ রাজ্যগুলোই ২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে জিততে সাহায্য করেছিল।
তিনি বলেছিলেন চীনের বন্দিশিবির তৈরি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল: চীনে উইঘুর মুসলিমসহ ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় ১০ লাখ মানুষকে জিনজিয়াং এলাকায় বন্দিশিবির তৈরি করে সেখানে আটকে রাখা হয়।
এসব বন্দিশিবিরে চীনা সরকার যে আচরণ করে তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। চীনা কর্তৃপক্ষের গণহারে উইঘুর আটক রাখায় ট্রাম্প যখন চীনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা অনুমোদন করেন তখন চীন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায়।
কিন্তু বোল্টন তার বইয়ে লিখেছেন, জিনপিং যখন ওই শিবির গঠনের পেছনে তার যুক্তি তুলে ধরেন তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন তিনি চীনের পদক্ষেপ সমর্থন করেন।
ট্রাম্প ‘একনায়কদের ব্যক্তিগতভাবে আনুকূল্য’ দিতে আগ্রহ দেখান: বোল্টন লিখছেন, ট্রাম্প যেসব স্বৈরশাসকদের পছন্দ করেন তাদের ব্যাপারে ফৌজদারি তদন্তে নাক গলাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যাতে ওইসব তদন্তে শাসকরা তার ব্যক্তিগত আনুকূল্য পান।
অভিশংসন নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের আরও আগানো উচিত ছিল: ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল যে, তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য ইউক্রেনের সরকারের ওপর চাপ দিয়েছিলেন।
বলেছিলেন তারা এটা না করলে আমেরিকা ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেবে। ডেমোক্র্যাটদের অভিযোগ সমর্থন করেছেন বোল্টন।
ওই অভিযোগের সূত্র ধরেই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নতুন যেসব অভিযোগ বোল্টন করেছেন, সেগুলো অভিশংসনের আওতাভুক্ত অপরাধ কিনা তা বলেননি।
ট্রাম্প প্রস্তাব দেন তিনি দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে চান: প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও শি জিনপিংয়ের আলাপ নিয়ে আরও কিছু কথা বোল্টন বলছেন, ট্রাম্প চীনা নেতাকে বলেছিলেন তিনি যাতে দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেন, তার জন্য প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে আমেরিকানরা খুবই আগ্রহী।
তিনি আরও লিখেছেন, ‘জিনপিং বলেছিলেন আমেরিকায় খুব বেশি নির্বাচন হয়, তিনি ট্রাম্পের জায়গায় আর কাউকে দেখতে চান না। ট্রাম্প মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলেন।’
ট্রাম্প জানতেন না যে যুক্তরাজ্য পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েট ইউনিয়নের পর ১৯৫২ সালে ব্রিটেন ছিল তৃতীয় দেশ যারা আণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়।
কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রধর স্বল্প কয়েকটি দেশের যে গোষ্ঠী রয়েছে, ব্রিটেন যে তার অংশ ট্রাম্প সেটা জানতেন না। এটা তার কাছে নতুন খবর।
বইয়ের একটি অংশে ২০১৮ সালে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র সঙ্গে এক বৈঠকের কথা বলা হয়েছে, যেখানে একজন কর্মকর্তা ব্রিটেনকে পরমাণু শক্তিধর দেশ বলে উল্লেখ করেন।
বলা হচ্ছে ট্রাম্প উত্তর দেন, ওহ আপনার দেশে পরমাণু অস্ত্র আছে বুঝি? বোল্টন লিখছেন, তিনি মজা করে এ কথা বলেননি।
ফিনল্যান্ড রাশিয়ার অংশ কিনা জানতেন না: বোল্টন বলছেন ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে এক বৈঠকের আগে, ট্রাম্প জিজ্ঞেস করেছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে ফিনল্যান্ড রাশিয়ার এক ধরনের উপরাষ্ট্র কিনা।
তিনি ন্যাটো থেকে আসলে বেরিয়ে আসছিলেন: প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ন্যাটো সামরিক জোটের সমালোচক ছিলেন বরাবর। তিনি অন্য সদস্য দেশগুলোকে তাদের তহবিল বাড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছিলেন।
এর পরও আমেরিকা ন্যাটোর সদস্য ছিল, কিন্তু বোল্টন লিখছেন, ২০১৮ সালে ন্যাটোর এক শীর্ষ বৈঠকে ট্রাম্প সিদ্ধান্ত নেন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো থেকে বেরিয়ে যাবে।
ভেনিজুয়েলা আক্রমণ দারুণ ব্যাপার হবে: ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে অন্যতম বড় একটা মাথাব্যথার বিষয় ছিল ভেনিজুয়েলা।
আর যুক্তরাষ্ট্র ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর কট্টর বিরোধী। দেশটি প্রসঙ্গে আলোচনায় ট্রাম্প বলেন, ভেনিজুয়েলা আক্রমণ করলে দারুণ হবে, আর দেশটি ‘আসলে কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই অংশ’।
এমনকি মিত্ররা তাকে নিয়ে মশকরা করেন: বোল্টনের বইয়ে বেশ কিছু উদাহরণ রয়েছে, যেখানে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ে মশকরা করার বিষয় উল্লেখ রয়েছে।
অকার্যকর একটা হোয়াইট হাউসের বর্ণনা দিয়েছেন, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী বৈঠকগুলো আসলে খাওয়া দাওয়ার পার্টি হয়ে দাঁড়ায়।
এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও, যিনি ট্রাম্পের অনুগত বলেই ধরে নেয়া হয় তিনিও প্রেসিডেন্টকে ফুল অফ শিট বা মাথা ভর্তি গোবর বলে একটি নোটে উল্লেখ করেছিলেন বলে এ বইয়ে দাবি করা হয়েছে।
Leave a reply