নরসিংদী প্রতিনিধি:
নরসিংদীর রায়পুরার চরাঞ্চলে মেঘনা নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে শতশত ঘরবাড়ি, হুমকির মুখে পড়েছে প্রায় লক্ষাধিক পরিবার। এতে খোলা আকাশের নীচে ও স্বজনদের বাড়িতে মানবেতর জীবন যাপন করছেন বাড়িঘর হারানো অসহায় এসব মানুষ।
অনেকে এলাকা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্যত্র। মেঘনা নদীতে যত্রতত্র ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হলেও স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি নেই বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
মঙ্গলবার সরেজমিনে রায়পুরার এসব ভাঙন কবলিত এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, প্রতি বছরের মতো এবারও বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই রায়পুরায় মেঘনা নদীতে দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। এতে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে চরাঞ্চলের চাঁনপুর, চরমধুয়া ও শ্রীনগর ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের শতশত বাড়িঘর, গাছপালাসহ ফসলি জমি।
দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত ভাঙ্গনের ফলে হুমকির সম্মুখীন এসব ইউনিয়নে অনেক গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ঈদগাহ মাঠ, মসজিদ, কবর স্থান ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। গত ১০ দিনে চরাঞ্চলের তিন ইউনিয়নে শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এরমধ্যে চাঁনপুর ইউনিয়নে ১৫টি বাড়িঘরসহ পুরো ইমাম দিরকান্দি গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। একই ইউনিয়নের কালিকাপুর ও সদাগরকান্দি গ্রামে ২৫টি বসতভিটা ও অনেক ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে।
শ্রীনগর ইউনিয়নের পলাশতলী গ্রামে একটি মসজিদ সহ ৩০টি বাড়িঘর মেঘনার ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। চরমধুয়া ইউনিয়নের বীর চরমধুয়া গ্রামে নতুন করে ২০টি পরিবার ভাঙনের শিকার হয়েছে। ঝুঁকিতে রয়েছে গ্রামটির একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, প্রাইমারী স্কুল, মসজিদ, মাদরাসা, কবরস্থান ও ঈদগাঁহ।
গত বছর চাঁনপুর, চরমধুয়া ও বীর চরমধুয়া গ্রামের শতাধিক পরিবার মেঘনার ভাঙ্গনে গৃহহীন হয়েছে। প্রতি বছর নদী ভাঙ্গনে মিরর্জারচরে অর্ধশত পরিবার ভিটেমাটি ও বহু ফসলি জমি বিলীন হয়ে যায়। মেঘনার ভাঙ্গন ঝুঁকিতে রয়েছে, স্কুল, মসজিদ ও বাজার। এছাড়া রায়পুরার চরসুবুদ্ধি ইউনিয়নের মহেষ ভেড় গ্রামেও দেখা দিয়েছে নদী ভাঙ্গন। অব্যাহত নদী ভাঙ্গনের ফলে বসতভিটা ও ফসলি জমি হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে এসব এলাকার মানুষ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চাঁনপুর ইউনিয়নের তিনটি মৌজায় মেঘনা নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বালু মহাল ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। দীর্ঘদিন ধরে এসব বালু মহালের ইজারাদাররা মেঘনা নদীতে দিন রাত সমান তালে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে নিয়ম বর্হিভূতভাবে বালু উত্তোলন করছে। ইজারাকৃত সীমানা ছাড়িয়ে যত্রতত্র ও মেঘনার তীরবর্তী এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙ্গন। এসব বালু উত্তোলনে একাধিক প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকায় স্থানীয়রা প্রতিবাদ করতে পারছে না।
অপরিকল্পিত ভাবে ইজারা প্রদান করা তিনটি বালু মহাল এর লোকজন এলাকা ছাড়িয়ে নদী তীরবর্তী এলাকায় বালু উত্তোলনের ফলে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হলেও নজরদারি নেই স্থানীয় প্রশাসনের। এতে প্রতি বছরই নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে পড়ছেন অনেকে।
শ্রীনগর ইউনিয়নের পলাশতলী গ্রামের কৃষক বজলুল হক বলেন, প্রতি বছরই ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বাপ দাদার ভিটেবাড়ি, জমি নদীতে চলে যাচ্ছে। সবকিছু হারিয়ে আমরা নিস্ব হয়ে পড়ছি।
চাঁনপুর ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের আজগর মিয়া বলেন, গত তিনবছরে এই গ্রামের শতাধিক বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। গত এক সপ্তাহে ১৮টি বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। এখন আমাদের আর কোন সম্পদ অবশিষ্ট নেই। চাঁনপুরে মেঘনা নদীতে বালু কাটার কারণেই এই ভাঙ্গন হচ্ছে।
ইমামদিরকান্দি গ্রামের সিদ্দিক মিয়া ও মুলহাজ বেগম বলেন, আমাদের গ্রামটা তিনবার ভাঙ্গনের ফলে এখন পুরো গ্রামই বিলীন হয়ে গেছে। এখন আমরা কোথায় আশ্রয় নেবো বুঝতে পারছি না। অনেকে পাশের গ্রামের অন্যের বাড়ি ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
চাঁনপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন বলেন, ড্রেজারে মাটি কাটার কারণে কয়েকটি গ্রামের মানুষ বাড়িঘর হারিয়ে অন্যত্র গিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সরকার নদীতে বালু মহাল ইজারা দিয়েছে, কিন্তু ইজারাদাররা মহালের সীমানা ছাড়িয়ে লোকজনের রেকর্ডকৃত (সিএস, আরএস, এসএ) জমি থেকে বালু তুলছে। এ কারণে এলাকাটি বিলীন হচ্ছে।
চাঁনপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মোমেন সরকার বলেন, নদী ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পেতে এসব বালু মহাল বন্ধের জন্য দীর্ঘ ৯ বছর ধরে আবেদন জানিয়েও কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। নদী ভাঙ্গনরোধে বালু উত্তোলন বন্ধ করা, বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও আশ্রয়হীনদের জেগে উঠা চরের খাস জমিতে বসবাসের ব্যবস্থা করণের দাবী জানান তিনি।
এ ব্যাপারে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন বলেন, বালু মহালের সীমানা ছাড়িয়ে বালু উত্তোলন করা হলে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। বালু তোলার কারণে যদি নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে বালু মহাল বন্ধ করে দেয়া হবে এবং গৃহহীন পরিবারগুলোর জন্য আবাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। চাঁনপুর ও চরমধুয়া ইউনিয়নে স্থায়ীভাবে নদী ভাঙ্গন ঠেকাতে একটি প্রতিরক্ষামূলক কাজ প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানান তিনি।
Leave a reply