পিনাক-৬ লঞ্চ ডুবি, এক ভয়াবহ ট্রাজেডির নাম। ভয়াবহ লঞ্চডুবিতে সরকারি হিসেবে ৪৯ জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার ও ৫৩ জন নিখোঁজ হলেও ৬ বছরেও বিচার সম্পূর্ণ হয়নি এ ঘটনার।
বিচার সম্পূর্ণ না হওয়ায় এ দূর্ঘটনায় জড়িত সন্দেহে করা ২টি মামলার আসামিরা রয়েছেন জামিনে। ৬ বছর অতিবাহিত হলেও দোষীদের বিচার না হওয়ায় নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনদের মাঝে দেখা গিয়েছে তীব্র ক্ষোভ।
লঞ্চটিতে ওঠার আগে বিশ্ব কাপানো স্বর্না হিরাসহ ৩ বোনের সেলফিই এখন পরিবারের একমাত্র সম্বল। একই উপজেলার ফরহাদের পরিণতি আরও ভয়াবহ। ফরহাদসহ পরিবারের ৪ জনের কারোরই লাশ পাওয়া যায়নি। নেই কোন স্মৃতির ছবিও।
নিখোঁজ অর্ধ শতাধিক পরিবারের কাউকেই দেয়া হয়নি কোন অনুদান। আর অজ্ঞাত হিসাবে ২১ জনের লাশ দাফন হলেও ডিএনএ নমুনাই রয়ে গেছে সব, মেলেনি পরিচয়। তাছাড়া আজও সন্ধান মেলেনি লঞ্চটির।
২০১৪ সালে ঈদুল ফিতরের পর ৪ আগস্ট ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বোঝাই আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে শিবচরের কাওরাকান্দি ঘাট থেকে পিনাক-৬ লঞ্চটি উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে মাওয়ার অংশে ডুবে যায়। সরকারিভাবে ওই ঘটনায় ৪৯ জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ থাকে ৫৩ জন।
নিহতদের মধ্যে অনেকেই স্বপরিবারে ও নিখোঁজদের অনেকেই স্বপরিবারে রয়েছে। তন্মধ্যে শিবচর পৌর এলাকার মো. নুরুল হক মিয়ার ঢাকার শিকদার মেডিকেলে ডাক্তারি পড়ুয়া মেয়ে নুসরাত জাহান হিরা ও রাজধানীর বীরশ্রেষ্ট নুর মোহাম্মদ কলেজের ছাত্রী ফাতেমাতুজ জোহরা স্বর্ণা এবং তারই ভায়রার মেয়ে চীনের জইনুস মেডিকেল কলেজের ছাত্রী শরিয়তপুরে গঙ্গানগর এলাকার জান্নাতুল নাঈম লাখী। এই দুর্ঘটনায় ৩ জন মারা গেলেও উদ্ধার হয়েছে ২ জনের মৃতদেহ। একজন এখনো নিঁখোজ।
এছাড়া শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা গ্রামের প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধা রিজিয়া বেগমের এক ছেলে মিজানুর রহমান, পুত্রবধূ রোকসানা বেগম, আড়াই বছর বয়সের নাতি মাহিন এবং এগারো বছর বয়সের নাতনি মিলিসহ একই পরিবারের ৪জন নিহত হয়।
এ দূর্ঘটনার পরপরই মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানা ও মেরিন কোর্টে ২টি মামলা হয়। আসামিরা গ্রেফতার হলেও বর্তমানে আদালত থেকে জামিনে রয়েছে। তবে ৬ বছর অতিবাহিত হলেও দোষীদের বিচার না হওয়ায় নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। এ দূর্ঘটনায় উদ্ধারকৃত ৪৯টি লাশের মধ্যে ২৮টি লাশ পরিবারকে বুঝিয়ে দেয়া হয় আর ২১ জনকে জেলার শিবচর পৌরকবর স্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। রেখে দেয়া হয় ওই ২১ জনের ডিএনএ টেস্টের নমুনা।
তবে এই ৬ বছরেও কেউ শনাক্ত করতে আসেনি লাশগুলোর। মাটির নিচে গলে পচে নিঃশেষ হয়ে আছে পরিচয়টুকুও। সরকারি হিসেবেই নিখোঁজ থাকে আরও ৫৩ জন। তবে বেসরকারি হিসেবে অন্তত শতাধিক যাত্রী নিখোঁজ রয়েছে। নিহতদের মধ্যে অনেকেই স্বপরিবারে ও নিখোঁজদের অনেকেই স্বপরিবারে রয়েছে। যে সকল পরিবারে এখনও স্বজনরা নিঁখোজ রয়েছেন তাদের ভাগ্যে জোটেনি কোন সরকারি অনুদান।
যদিও ২৮ পরিচয়ধারী নিহতদের তাৎক্ষণিকভাবে ২০ হাজার টাকা করে ও পরিবর্তীতে ঘোষিত ১ লাখ ৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে অনেক অসহায় পরিবারকে কাটাতে হচ্ছে মানবেতর জীবন। গত ৬ বছরেও কেউই তাদের খোঁজ নেয়নি। এতে ক্ষোভের অন্ত নেই স্বজনহারা পরিবারগুলোতে।
ঘটনার পর লৌহজং ও শিবচরে স্থাপন করা হয় অভিযোগ ও তথ্য কেন্দ্র। এ ঘটনার পরপরই নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর ৭ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। দোষীদের বিচার সম্পূর্ণ না হওয়ায় স্বজন হারানোদের ক্ষোভের কোন অন্ত নেই। এরপরও তারা চান নৌ-যাত্রা নিরাপদ হোক।
৫ বছরেও দোষীদের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন নিহত স্বর্ণা ও হিরার পিতা নুরুল হক।
দূর্ঘটনার পর নানান পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানান বিআইডব্লিউটিএ টার্মিনাল ইন্সপেক্টর আক্তার হোসেন।
অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করাদের ডিএনএ সংরক্ষণ করে রাখলেও নিখোঁজদের ব্যাপারে কেউ এই ৫ বছরেও আসেনি বলে জানান শিবচর পৌরসভা মেয়র আওলাদ হোসেন খান। তিনি এ ঘটনার দীর্ঘ বিলম্বে ক্ষুদ্ধ।
তবে পিনাক-৬ দূর্ঘটনার পর এরুটে নৌযান পারাপারের ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান।
Leave a reply