বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করাই ছিল যাদের অপরাধ

|

ছবি: ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে গ্রেফতারকৃত ২২ জনের একাংশ।

ভৈরব প্রতিনিধি:

ভৈরবের হাজি আসমত কলেজের ছাত্রাবাস। তা দোতলায় একদল পুলিশ উঠে বলে উঠল তোরা কিসের মিলাদ আয়োজন করেছিস? প্রশ্ন করেই পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত সবাইকে লাঠিপেটা শুরু করলো। সেখানে উপস্থিত ২২ জনকে গ্রেফতার করা হলো। বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হলো মামলা, পাঠানো হলো করাগারে। সেদিন তাদের অপরাধ ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী দিবসে তারা মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করা।

ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট। এদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের আয়োজনে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল। এই কারণে দীর্ঘদিন কারাভোগ করার পর তারা পর্যায়ক্রমে জেল থেকে ছাড়া পায়। সেদিনের এসব কথা বললেন সেই সময়ের গ্রেফতারকৃত ছাত্রনেতা রসরাজ সাহা ও মতিউর রহমান।

সেই দিনের ঘটনায় যারা গ্রেফতার হয়েছিল তারা হলো, তৎকালীন থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আলম আক্কাছ (বর্তমানে পৌর মেয়র), ছাত্রলীগ নেতা আসাদুজ্জামান ফারুক (বর্তমানে সাংবাদিক), রুহুল আমীন, মাহবুব, মতিউর রহমান, মফিজুর রহমান, মোশারফ হোসেন (জজ মিয়া), জিল্লুর রহমান জিল্লু, আসাদ মিয়া, আতাউর রহমান, আসাদুল হক শিশু, ফিরুজ মিয়া, দীলিপ চন্দ্র সাহা ও তার ভাই দীজেন্দ্র চন্দ্র সাহা, ফজলুর রহমান, আবদুল হামিদ, ইদ্রিছ মিয়া, মাহবুব আলম, রসরাজ সাহা, সুবল চন্দ্র কর, শাহজালাল হোসেন ও আজমল ভূঁইয়া।

এবারের ১৫ আগস্ট হবে বঙ্গবন্ধুর ৪৫ তম শাহাদাত বার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের পর দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়। ভয়ে কেউ বঙ্গবন্ধুর নামটি উচ্চারণ করতো না। এই দুঃসময়ে ভৈরবে ২২ জন নেতাকর্মী তৎকালীন হাজি আসমত কলেজের শহীদ আশুরঞ্জন ছাত্রাবাসে (বর্তমান শৈবাল হোটেল) আয়োজন করে মিলাদ মাহফিল, দোয়া ও কোরআন খতমের।

বিকেল সাড়ে ৩টায় ১২ জন মৌলভি ছাত্রাবাসে এসে কোরআন খতম শুরু করে। বিকেল ৪টার মধ্য ২২ জন নেতাকর্মী মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়। যুবলীগ নেতাদের নিমন্ত্রণে স্থানীয় অনেক যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী মিলাদে অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময় সামরিক সরকারের ভয়ে অনেকেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়নি।

সেদিন মিলাদ শুরুর আগেই গোয়েন্দাদের কাছে খবর পৌঁছে যায়। স্থানীয় প্রশাসন তখন নির্দেশ দেয়, আয়োজন বন্ধ করে আয়োজনকারীদের গ্রেফতার করতে। এই নির্দেশ দেয়ার পর ভৈরব থানা পুলিশের ২০/৩০ জন পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে এসে ছাত্রাবাসটি ঘিরে ফেলে। এ সময় পুলিশ ছাত্রাবাসে ঢুকেই অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও নির্যাতন শুরু করে। এরপর ২২ জনকে গ্রেফতার করে এবং মৌলভিদেরকে আটক করার পর থানায় নিয়ে মুচলেকা রেখে মৌলভিদেরকে ছেড়ে দিলেও ২২ জনকে আটকে রাখা হয়।

সেই দিনের গ্রেফতারকৃত যুবলীগ নেতা ফখরুল আলম আক্কাছ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ করতে গিয়ে বেঁচে গেছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ঘাতকরা হত্যা করেছে। সেখানে আমাদের গ্রেফতার একটি তুচ্ছ ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর নামে মিলাদ দোয়া পড়ানো ছিল সেদিন আমাদের অপরাধ। এ কারণে আমি এক বছর কারাগারে বন্দি ছিলাম। তখন ফাঁসির সেলে আমাকে বন্দি করে রেখেছিল।

আরেক গ্রেফতারকৃত নেতা মতিউর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর কয়েক বছর এদেশে কেউ তার নামটি উচ্চারণ করতে ভয় পেত। আমরা সেদিন দুঃসাহসিকতার সাথে মিলাদের আয়োজন করেছিলাম। এখন আমাদের দল ক্ষমতায় কিন্তু দলীয় নেতারাও আমাদের স্মরণ করে না। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ যদি পেতাম তবে ক্ষোভের কথাগুলি বলতে পারতাম।

সেই দিন গ্রেফতারকৃত ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান ফারুক বলেন, সেই সময় আমি কলেজে পড়তাম। বঙ্গবন্ধুর জন্য মিলাদ দোয়ার আয়োজনে অংশ নিয়ে গ্রেফতার হয়ে ৫ মাস ২৭ দিন কারাগারে ছিলাম। সেই দিনের কথাগুলি মনে পড়লে আজও আমার শরীর শিউরে উঠে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply