মো: আবু জুবাইর হোসেন:
গত ২৫ শে জুলাই ভারত মহাসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্র মরিশাসের দক্ষিণ উপকূলে ৩০০ মিটার লম্বা এবং ২ লাখ টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ক্যাপসাইজ বাল্ক ক্যারিয়ার এম ভি ওয়াকাশিয়ো রিফের সাথে ধাক্কা খেয়ে আটকে যায় এবং একটি জ্বালানি তেলের ট্যাংক ফেটে গিয়ে জাহাজটির ইঞ্জিনের জন্য সংরক্ষিত প্রায় ৪ হাজার টন জ্বালানি তেলের ১ হাজার টন পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। এটি মরিশাস উপকূলে ভয়াবহ ইকোলজিক্যাল ক্ষতি করেছে। পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল এই দেশটির ইতিহাসে সব থেকে বড় দুর্ঘটনার একটির মনে করা হচ্ছে এটিকে। মরিশাসে পোর্টে অয়েল ট্যাংকারে কর্মরত থাকায় আমাদের জাহাজটিসহ অন্য আরো দুটি জাহাজকে দায়িত্ব দেয়া হয় পাম্প করে দুর্ঘটনা কবলিত জাহাজে সংরক্ষিত প্রায় ৩ হাজার টন তেলকে যেকোনো মূল্যে আমাদের জাহাজে নেয়ার জন্য, কারণ বাকি তেল ও যদি সাগরে পড়ে যায়, তাহলে পুরো মরিশাসে ভয়ানক প্রভাব পড়বে।
দুর্ঘটনার পরপরই সালভেজ টিমকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জাহাজটি দেখভালের, কিন্তু তারা জানিয়েছিল জাহাজ থেকে তেল ছড়িয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই; কিন্তু আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় এবং জাহাজটিকে রিফ থেকে বের করার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায়, জ্বালানি ট্যাংক ফেটে গিয়ে তেল উপকূলে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে নেদারল্যান্ডের অন্য একটি সালভেজ টিমকে দায়িত্ব দেয়া হয়। জাপান থেকে ৬ জনের একটি টিম এবং ফিলিপাইনসহ আরো কয়েকটি দেশ থেকে দক্ষ লোকজন কাজ করতে শুরু করে; প্রধান কাজ ছিল জাহাজ থেকে ৩ হাজার টন তেল অপসারণ করা, এজন্য জাহাজের পাশাপাশি হেলিকপ্টারে করেও ড্রামে ভরে তেল অপসারণ শুরু হয়; আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় তেল অপসারণ করা আরো কঠিন হয়ে পড়ে; আমাদের জাহাজ ২ দিন পর্যন্ত জাহাজটির কাছে ভিড়তে পারেনি। মরিশাসে এজন্য “প্রাকৃতিক জরুরি অবস্থা” ঘোষণা করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তেল ছড়িয়ে পড়ার কারণে সামুদ্রিক পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। বিভিন্ন ধরনের বিলুপ্তপ্রায় সামুদ্রিক প্রবালসহ, মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী ধ্বংস হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, মরিশাসের এই উপকূলটি বিশ্ব ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত অংশ, যা দেখার জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক আসে, যা মরিশাসের আয়ের সব থেকে বড় উৎস। তবে আশার কথা, সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় সব তেল জাহাজের ট্যাঙ্ক থেকে অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে। সালভেজ টিম কাজ করছে, রিফ থেকে জাহাজটিকে পরিপূর্ণভাবে অপসারণের জন্য। যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে তেল অপসারণের কাজে অংশ নিয়েছি, জাহাজ দুর্ঘটনা ও ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত কিছু দিক বোঝার চেষ্টা করেছি।
জাহাজ এবং এর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান: এমভি ওয়াকাশিয়ো নামের ৩০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজটি ২০০৭ সালে তৈরি। এটি মজবুত এবং খুবই টেকসই যেকোনো ধরনের আঘাত সহ্য করার মতো শক্তিশালী মেটেরিয়াল দিয়ে তৈরি। জাপানের নাগাসাকি শিপিং লাইনের মালিকানাধীন জাহাজটি মিটসুই ওএসকে নামক একটি জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান চার্টার নিয়ে পরিচালনা করছিল। তাদের দেয়া তথ্য মতে, পানামার পতাকাবাহী জাহাজটি ২০ জন মিক্সড ক্রু নিয়ে চায়নার তিয়ানজিং বন্দরের কার্গো খালি করে লোড করার জন্য ভারত মহাসাগর দিয়ে ব্রাজিলের দিকে যাচ্ছিল। পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান দুর্ঘটনার কারণ এখনো জানাতে পারেনি।
দায়ভার কার: ২০০১ সালের স্বাক্ষরিত “INTERNATIONAL CONVENTION ON CIVIL LIABILITY FOR BUNKER OIL POLLUTION DAMAGE”, যা পরবর্তিতে “BUNKER CONVENTION” নামে আন্তর্জাতিক নৌসংস্থা (IMO) থেকে ২০০৮ সালে অনুমোদিত হয়, সেই আইন অনুযায়ী জাহাজের মালিক ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য, তারমানে মিটসুই ওএসকে’র থেকে নাগাসাকি শিপিং লাইনের উপরই এর দায়ভার বেশি বর্তায়। ১৩ আগস্ট নাগাসাকি শিপিং লাইন জানায়, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই তারা ক্ষতিপূরণ দিবে। এদিকে, মিটসুই ওএসকে লাইনের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট আশিকিকো ওনো এই দুর্ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন, কিন্তু ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কিছুই বলেননি।
ক্ষতিপূরণের বাধ্যবাধকতা: ১৯৭৬ সালের কনভেনশন অনুযায়ী মেরিটাইম অ্যাক্টের ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ জাহাজ মালিক পরিশোধ করবে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের আইনে বলা হয়, ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ তখনই প্রযোজ্য হবে যখন জাহাজটি পর্যাপ্ত ইন্স্যুরেন্সের আওতায় থাকবে। টোকিও’র আইন অনুযায়ী, মরিশাস ১৯৭৬ সালের আইনের আওতায়,যার জন্য তারা ২ বিলিয়ন জাপানি ইয়েন সমমূল্যের ১৮.৮ মিলিয়ন ইউএস ডলার জরিমানা পেতে পারে। যেখানে জাপান ১৯৯৬ সালের আইনে স্বাক্ষর করায় সর্বোচ্চ ৭ বিলিয়ন জাপানি ইয়েন ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। এখন আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থার মাধ্যমেই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নির্ধারিত হবে।
ইন্স্যুরেন্স: জাহাজটি জাপানের ‘পি অ্যান্ড আই ক্লাব’ ইন্স্যুরেন্সের আওতাভুক্ত, যা শিপিং সেক্টরে সব থেকে বড় ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তারা জানিয়েছে, তেল বর্জ্য অপসারণ বাবদ যা অর্থ তা নিরূপন করা হচ্ছে। তারপর সে অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এদিকে, মরিশাস সরকার এখনো ক্ষতিপূরণ বাবদ কত অর্থ ব্যয় হবে তার কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। এস এন্ড পি গ্লোবাল রেটিংসের বিশ্লেষক কোশিও ইমুরা র মতে, পি এন্ড আই’র ক্ষতিপূরণের অংক সর্বোচ্চ ১ বিলিয়ন ইউএস ডলার হতে পারে।
জাহাজের অপসারণ প্রক্রিয়া: জাহাজটির অপসারণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল একটি ব্যাপার, এবং কমপক্ষের আরো একমাস লাগতে পারে। ফ্রান্স, যারা এক সময় মরিশাসকে নিজেদের কলোনি হিসেবে ব্যবহার করেছে, তারা বলেছে জাহাজটি অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সব রকমের সহায়তা তারা দেবে। জাপান ও তাদের দক্ষ লোকবল এবং লজিস্টি সাপোর্ট দিচ্ছে, ভারত থেকেও বিশেষ বিমানে করে ২৫ জনের একটি টিম প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ নিয়ে মরিশাস এসেছে। International Maritime Organaization ( IMO ) প্রয়োজনীয় ট্যাকনিক্যাল সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
সর্বোপরি , ক্ষতিপূরণ যাই হোক না কেন, মরিশাস উপকূলের যে পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে তা কোনো টাকার অংকে পূরণ করা সম্ভব নয়। তবে, বৈরি আবহাওয়ার মধ্যেও মরিশাসের জনগণ যেভাবে তীরে ভেসে আসা তেল, বর্জ্য অপসারণের জন্য স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। হয়তো দুর্ঘটনার কারণ জানা যাবে, ক্ষতিপূরণ আসবে, কিন্তু দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে আরো কঠোর আইন করতে হবে। এছাড়া সমুদ্রপথে যাত্রাকে নিরাপদ করতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবি।সমুদ্র হোক নিরাপদ।
লেখক: মার্চেন্ট মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, মরিশাস।
Leave a reply