দেশে বিচারাধীন মামলা প্রায় ৩৭ লাখ। এর মধ্যে দেওয়ানি ১৫ লাখ আর ফৌজদারি ২১ লাখ। এগুলোর মধ্যে ৫ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন প্রায় ৬ লাখ মামলা। ১৩ হাজার মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে, তৈরি হচ্ছে মামলাজট। বিচারক স্বল্পতা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও ব্যবস্থাপনা ত্রুটিই এর অন্যতম কারণ। এ জট নিরসনে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, তবে তা কোনো কাজে আসছে না। এ নিয়ে বাড়ছে বিচার প্রার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও হতাশা।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বর্তমান অবস্থায় জট কমাতে হলে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে মহাপরিকল্পনা।
আইন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, গত ১০ বছরে সহকারী জজ পদে সারা দেশে প্রায় ১১শ’ বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে পর্যাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা পদায়ন করা হয়েছে। এছাড়া ১২তম জুডিশিয়াল সার্ভিস নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী জজ নিয়োগের কার্যক্রমও শেষ হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে অধস্তন আদালতে প্রায় দুই হাজার বিচারক রয়েছেন। এরপরও মামলাজট কমছে না।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, মামলাজট নিয়ে আমার কিছু পরিকল্পনা আছে, সেগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে চাই। আমি প্রধান বিচারপতিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বসব। ২০২১ সালের জানুয়ারির মধ্যে একটা কর্মপন্থা বের করব- কিভাবে এ জট নিরসন করা যায়।
‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ পন্থায় আদালতের বাইরে অনেক মামলা নিষ্পত্তি করার তাগিদ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য অনেকেই আদালতে মামলা করেন। এ বিষয়ে মানুষদের নিরুৎসাহিত করতে হবে, অযথা যেন কেউ মামলা না করতে পারেন।
সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সারা দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭২৮টি। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১৪ লাখ ৭৮ হাজার ৮২৭ এবং ফৌজদারি ২১ লাখ ৬ হাজার ৬৯২টি। বাকিগুলো অন্যান্য মামলা। এসব মামলার মধ্যে ৫ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৭১৮টি দেওয়ানি এবং ২ লাখ ৩৬ হাজার ১১৬টি ফৌজদারি মামলা। এগুলোর মধ্যে উচ্চ আদালতে স্থগিত আছে ১৩ হাজার ৬০৭টি দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা। এর আগে ২০১৮ সালের জনুয়ারি পর্যন্ত ৫ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন ছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ৫৫৯টি দেওয়ানি এবং ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪৫৫টি ফৌজদারি মামলা। আর ওই সময় উচ্চ আদালতে স্থগিত মামলার সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ২৯০টি। এতে দেখা যায়, এক বছরে এমন মামলার সংখ্যা বেড়েছে।
মামলাজট প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, বর্তমান অবস্থায় জট কমাতে হলে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে মহাপরিকল্পনা। তিনি বলেন, মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা কমার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। যেমন- অনেক মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিচার শেষ না হওয়ার আগেই বিচারককে অন্যত্র বদলি করা হয়। এক্ষেত্রে নতুন বিচারক এসে মামলাটি বুঝতে সময় লাগে। অনেক মামলা আছে নতুন করে শুনানি করা হয়। এছাড়া মামলায় সাক্ষী না আসার কারণে অনেক সময় মামলা এগোতে পারে না। সময়মতো সাক্ষীকে উপস্থাপন না করায় বিচার সম্পন্ন হতে সময় লাগছে। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাইলে বিচারক ও তাদের সহায়ক লোকবল বাড়াতে হবে, এর আগে ব্যবস্থাপনায় একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার।
জ্যেষ্ঠ এ আইনজীবী আরও বলেন, আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলাজট কমিয়ে আনা সম্ভব। এ লক্ষ্যে আইনও সংশোধন করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লাগছে। রায় যখন মেলে, তখন প্রাসঙ্গিকতাই থাকে না। শফিক আহমেদ বলেন, মামলাজট কমাতে হলে সর্বোচ্চ এক বা দু’দিন মুলতবি করে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে।
সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সরকারের শাসন ব্যবস্থায় মিথ্যা মামলার সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু বিচারকের সংখ্যা বাড়ছে না। ভুয়া মামলা করার প্রবণতা বন্ধ করলে মামলাজট কমবে।
Leave a reply