পাবনা প্রতিনিধি:
পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) আসনে উপনির্বাচন উপলক্ষ্যে ঈশ্বরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মেয়র মিন্টু ও সাধারণ সম্পাদক ইসাহক মালিথা গ্রুপের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষে অন্তত ১২ জন আহত হয়েছে।
সোমবার দুপুর ১২টার থেকে ২টা পর্যন্ত কয়েক দফায় ঈশ্বরদী উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষ ও ছুরিকাঘাতে আহতরা হলো, ঈশ্বরদী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইসাহক আলী মালিথা, মুলাডুলি ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কার মালিথা, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কবির মালিথা, পৌর যুবলীগের সভাপতি আলাউদ্দিন বিপ্লব, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সজিব মালিথা, যুবলীগ কর্মী নাজিম উদ্দিন রনি, পৌর যুবলীগের সাবেক সভাপতি সানোয়ার হোসেন লাবু, রিকশা চালক ওলিউর রহমান, ৪ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আজিজ, ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কাশেম গোলবার হোসেন, যুবলীগ নেতা আমিরুল ইসলাম, সেলিম রেজা ও আওয়ামী কর্মী আবু কালাম।
এসময় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন, বিশিষ্ট শিল্পপতি মুক্তিযোদ্ধা অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রিন্স এমপি, এ্যাডভোকেট শামসুর রহমান টুকু এমপি, পাবনা উপজেলা চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন, পাবনা পৌর মেয়র কামরুল হাসান মিন্টু, ঈশ্বরদী আটঘরিয়া আসনে উপনির্বাচনে প্রার্থী নুরুজ্জামান বিশ্বাসসহ জেলা ও উপজেলার জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন ঈশ্বরদী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে ঘটনার সময় উপস্থিত নেতাকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে জানা যায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আসন্ন উপনির্বাচন উপলক্ষ্যে আয়োজিত বর্ধিত সভায় প্রধান অতিথি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেনসহ আগত অতিথিদের বরণ করার জন্য কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম লিটনকে সঙ্গে নিয়ে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইসাহক আলী মালিথা দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এই সময় পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মেয়র আবুল কালাম আজাদ মিন্টু তার সমর্থিত ২০-২৫ জন যুবলীগ, ছাত্রলীগ সমর্থকদের নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। মেয়র মিন্টু তার লোকজন নিয়ে লিটনের সামনে এসে দাঁড়ান। এই সময় তাঁদের ধাক্কা ধাক্কি শুরু হয়। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এই সময় মেয়র মিন্টুর পক্ষের লোকজন ইসাহক মালিথাসহ তার পক্ষের লোকজনকে কিল, ঘুষি ও ইট পাটকেল দিয়ে আঘাত করে। এতে ইসাহক মালিথা, বক্কার মালিথা, কবির মালিথা রক্তাক্ত হন।
অপরদিকে মেয়র মিন্টুর পক্ষের লাবু ও রনির পেটে এবং বুকে চাকুবিদ্ধ করে রক্তাক্ত করা হয়। উপস্থিত অতিথিদের হস্তক্ষেপে আহতদের উদ্ধার করে ঈশ্বরদী উপজেলা কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
খবর পেয়ে ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফিরোজ কবিরের নেতৃত্বে ঈশ্বরদী থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে অবস্থান নেন ও পরিবেশ শান্ত করেন। এই খবর চাউর হলে মুহুর্তের মধ্যে ইসাহক মালিথা ও মেয়র মিন্টু গ্রুপের লোকজন ঘটনাস্থলে জমায়েত হয়। পক্ষে-বিপক্ষে নানা রকম শ্লোগান দিতে থাকে তারা।
এরপর আহত ইসাহক মালিথা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে সভাস্থলে আসলে পূনরায় উত্তেজনা দেখা দেয়। তখন কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে ইসাহক মালিথা কার্যালয়ের ভেতরে সভাস্থলে যান। তখন অতিথিবৃন্দ মেয়র মিন্টু ও ইসহাক মালিথার মধ্যে মিল করিয়ে দেন।
আর নিজের ভুলের জন্য মেয়র মিন্টু হাত জোড় করে সকলের নিকট ক্ষমা চান। এরপর অতিথিদের নির্দেশে কার্যালয়ের বাইরে থাকা উভয় গ্রুপের উত্তেজিত কর্মী সমর্থকদের শান্ত করতে মেয়র মিন্টু ও ইসাহক মালিথা বাইরে বের হন। তখন ইসাহক গ্রুপের লোকজন মেয়র মিন্টুর উপর হামলা করার চেষ্টা করে।
এই সময় পূনরায় উভয় গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। তখন পুলিশের কঠোর ভূমিকায় মেয়র মিন্টু ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। এরপরে অবস্থা আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পুরো শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন নৌকা প্রার্থী নুরুজ্জামান বিশ্বাসকে পুলিশ পাহারায় দ্রুত আওয়ামী লীগ কার্যালয় থেকে নিজ বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এসব ঘটনাকে অত্যান্ত দূঃখজনক বলে মন্তব্য করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ঈশ্বরদী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মেয়র আবুল কালাম আজাদ মিন্টু ও সাধারণ সম্পাদক ইসাহক আলী মালিথাই মুল দায়ী। তবে উভয় পক্ষেই ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। তাই দোষীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের পুর্বে তদন্তের জন্য ঈশ্বরদী উপজেলা ও পৌর ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সকল কার্যক্রম স্থগিত করতে জেলা যুবলীগ ও ছাত্রলীগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কোন সন্ত্রাসী ও অপরাধী আওয়ামী লীগে থাকতে পারবে না।
নৌকা প্রার্থী নুরুজ্জামান বিশ্বাস সাংবাদিকদের বলেন, নৌকার জনজোয়ার যদি পৌর আওয়ামী লীগের দুই নেতা কারণে নষ্ট হয়। তাহলে তারা দায়ী থাকবেন। একই সঙ্গে মেয়র মিন্টু ও ইসহাক মালিথাকে পৌরসভার বাইরে নির্বাচনের মাঠে না যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন তিনি।
ঈশ্বরদী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মেয়র আবুল কালাম আজাদ মিন্টু সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে লুকিয়ে থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা নৌকার তলা কাটছে। তাদের উদ্দেশ্যমূলক ষড়যন্ত্রের কারণেই আজকে আমার ও আমার কর্মীবাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে আহত করা হয়েছে।
পৌর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ইসাহক আলী মালিথা সাংবাদিকদের বলেন, নৌকার জোয়ারকে নষ্ট করতে মেয়র মিন্টু তার বাহিনী নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে পরিকল্পনা করে আসছিল। আমরা তা সহ্য করে আসছি। বিগত পৌর নির্বাচনে আমি (ইসাহক মালিথা) প্রার্থী হতে চাওয়া থেকে মেয়র মিন্টু আমার সঙ্গে গ্রুপিং শুরু করেছে। আমার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর, লুটপাট করেছে। আজকে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া নুরুজ্জামান বিশ্বাসের বাড়িতেও মিন্টু তার লোকজন দিয়ে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও লুটপাট করেছে। ঘটনার সময় উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মিন্টু আমাকেসহ আমার লোকজনের উপর হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত জখম করেছে।
ইসাহক মালিথা আরও বলেন, মেয়র মিন্টু তার বাহিনী দিয়ে শহরে নানা রকম চাঁদাবাজী, দখলবাজীসহ নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন। ঈশ্বরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের এ সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মকলেছুর রহমান মিন্টু বলেন, এটা একটা চরম দুঃখজনক ও অনাকাঙ্খিত এবং নিন্দনীয় ঘটনা। নির্বাচনের আগে এই ধরণের সংঘর্ষ একেবারেই কাম্য নয়।
ঈশ্বরদী থানা সূত্রমতে, বেশ কয়েকদিন আগে থেকে মেয়র মিন্টু গ্রুপ ও ইসাহক আলী গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। বিষয়টি জানতে পেরে পুলিশের পক্ষ থেকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়। এই জন্য ঘটনার সময় প্রাণহাণির মতো বড়ো কোন দূর্ঘটনা ঘটতে পারেনি।
তবে মেয়র মিন্টু ও ইসাহক মালিথা গ্রুপের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ ঘটলেও পুলিশ তা কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। এই সময় প্রার্থী নুরুজ্জামান বিশ্বাসকে পুলিশী নিরাপত্তায় একটি মাইক্রোযোগে নিজ বাসাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সুত্র মতে, এই ঘটনায় হাসপাতালে রক্তাক্ত অবস্থায় ইসাহক মালিথা, আবু বক্কার মালিথা, লাবু ও রনিসহ অন্তত ১৫ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে লাবু ও রনি চাকুবিদ্ধ হওয়ায় তাদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।
ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফিরোজ কবির বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে অতিরিক্ত পুলিশসহ উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি শান্ত করা হয়। এই ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এই বিষয়ে থানায় কোন পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়নি। কাউকে গ্রেফতারও করা হয়নি। শহরের পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। তারপরও শহরে পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে। আর যেন কোনরুপ ঘটনা না ঘটে সেই জন্য সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছে।
Leave a reply