বাগেরহাট প্রতিনিধি:
বাগেরহাট জেলা আইনজীবী সমিতি আইন মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন স্থানীয় বিচার বিভাগের জমি অবৈধভাবে দখল করে একাধিক ভবন নির্মাণ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আইনজীবীদের এই সংগঠন আইন অমান্য করে বিচার বিভাগের জমি দখল করে ইতোমধ্যে চারটি ভবন তৈরি করেছে। যার দু’টি ভবনই অবৈধ।
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা জমির বিরোধ নিরসনে স্থানীয় জেলা জজশীপ উদ্যোগ নিলে আইনজীবীরা নানা অজুহাতে তা এড়িয়ে যাচ্ছেন। তবে জেলা আইনজীবী সমিতি জেলা জজশীপের করা অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো এসব জমির মালিকানা তাদের বলে দাবি করেছে। তবে তারা জমির মালিকানা দাবি করলেও তাদের পক্ষে জমির কোন দলিল দেখাতে পারেনি।
সম্প্রতি তারা বিচার বিভাগের আরও কিছু জমির মালিকানা দাবি করে তারকাঁটা দিয়ে ঘিরে নেওয়ায় জেলা জজশীপ ও আইনজীবী সমিতি পরষ্পর মুখোমূখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। এই চলমান বিরোধ নিরসন না হলে জেলা জজশীপের সাথে আইনজীবীদের সাংঘর্ষিক রুপ নিতে পারে আশঙ্কা করছেন বিচার বিভাগ। তাই এই বিরোধ নিরসনে সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ চাইছে জেলা জজশীপ।
সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বাগেরহাট নতুন আদালত এলাকায় চারতলা ভবন। তার পাশে আরও একটি নতুন চারতলা ভবনের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও শহরের পুরাতন কোর্ট এলাকায় চার বছর আগে তিনতলার একটি ভবন নির্মাণ করে সেখানে বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেয়া হয়েছে (ভবনটি মোক্তার বার নামে পরিচিত)।
এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে আইনজীবী সমিতি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আরও একটি নতুন ভবনের দাবি তুললে প্রধানমন্ত্রী তাদের নিজস্ব মালিকানায় থাকা জমিতে ছয়তলা ভবন করতে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। তারা এই টাকা বরাদ্দ পেয়ে বিচার বিভাগের মালিকানাধীন জমি বরাদ্দ চাইলে বিচার বিভাগ মানবিক কারণে ১৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ জমি মৌখিকভাবে বরাদ্দ দেয়। সেখানে তারা একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করেছে।
আইনজীবী সমিতিকে যে পরিমাণ জমি বিচার বিভাগ বরাদ্দ দিয়েছে তারা তার থেকেও বেশি দখল করে সীমানা তারকাঁটা দিয়ে ঘিরে নিয়েছে। এই এলাকায় আইনজীবী সমিতি বর্তমানে ৪৪ শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছে বলে অভিযোগ।
পুরানো নথি থেকে জানা গেছে, ১৯১৫ সালের সেক্রেটারি কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া আইন অনুযায়ী আইন পেশায় থাকা আইনজীবীদের বার লাইব্রেরি করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সেই আইন অনুযায়ী ১৯২৯ সালের ৪ এপ্রিল ১৪৮১ নাম্বার দলিলে বাগেরহাটের আইনজীবীদের বার লাইব্রেরি করতে ১৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ জমির অঙ্গীকার নামা দেয়া হয়। সেখানে একটি ভবন (দালান-১) নির্মাণ করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করার বিধান রয়েছে।
তাদের দেয়া অঙ্গীকারনামার শর্ত অনুযায়ী ওই বার লাইব্রেরির জায়গা বিচার বিভাগ চাইলে তা ছয় মাসের ভেতরে ছেড়ে দিতে হবে। আর এই বার লাইব্রেরিতে বাণিজ্যিকীকরণে ব্যবহার করা যাবে না বলেও আইনে উল্লেখ রয়েছে।
বাগেরহাট জেলা দায়রা জজ আদালতের নাজির মো. রাকিবুল ইসলাম আইনজীবী সমিতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, বিচার বিভাগের ১৯১৫ ও ১৯২৯ সালে আইন অনুযায়ী বাগেরহাট জেলা আইনজীবী সমিতিকে বার লাইব্রেরি নির্মাণ করতে দুই দফায় নতুন ও পুরাতন কোর্ট এলাকায় পাঁচ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং ১৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ জমির একটি অঙ্গীকারনামা দেয়া হয়। তারা তাদের অঙ্গীকারনামা অমান্য করে অতিরিক্ত আরও দু’টি ভবন নির্মাণ করেছে।
তিনি অভিযোগ করেন, সর্বশেষ আমরা পুরাতন কোর্ট এলাকায় যে ১৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ জমি দিয়েছি সেখানে তারা অতিরিক্তি প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি দখল করে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে নিয়েছে। তাদের নির্মিত ও নির্মাণাধীন ভবনগুলো বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দিচ্ছে। যা অঙ্গিকার নামার পরিপন্থী।
পুরতন কোর্ট এলাকায় বারের নির্মাণাধীন ভবনের বাইরেও রাষ্ট্রের মালিকানাধীন জমি অবৈধভাবে জমি ঘিরে নিয়েছে বার। বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
এর আগে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ওই বিরোধ নিস্পত্তিতে জেলা জজ নারী ও শিশু আদালতের বিচারককে প্রধান করে গত ৩১ আগস্ট ৫ সদস্যের একটি কমিটি করে দেয়। কমিটির কাছে তারা এখনও মালিকানা বাদি করা জমির কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। কিন্তু এই সময়ে তাদের সেখানে কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ ছিল। তা ভঙ্গ করেই তারা কাঁটাতার দিয়ে জমি ঘিরে নেয় ও কাজ অব্যাহত রাখে।
সম্প্রতি জেলা জজশীপের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তিপ্রস্তর ফলক ভেঙে ফেলা, নির্মাণ শ্রমিককে মারধর ও নির্মাণ সামগ্রী লুটের অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে নাজির বলেন, আইনজীবীরা জজশীপের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করেছে তা কাল্পনিক। রাতের অন্ধকারে সেখানে আমাদের কোন কর্মচারি যায়নি। বাগেরহাটের আইনজীবী সমিতির সাথে বিচার বিভাগের চলা বিবাদ নিরসন করতে আইন মন্ত্রণালয়ও অবহিত। আইন মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন সব সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ চান এই কর্মকর্তা।
ইতোপূর্বেও বাগেরহাট জেলা আইনজীবী সমিতি এই জমি নিজেদের করে নিয়ে নানা পন্থা আঁটে দাবি করে তিনি আরও বলেন, হাল জরিপের (বিআরএস) মাঠ পর্চায় ওই এলাকার ১.৭৩৬ একর জমি নিজেদের নামে রেকর্ড করায় আইনজীবী সমিতি। অবশ্য ১৫ আগস্ট ২০০৩ সালে প্রকাশিত ওই মাঠ জরিপের আগে ১৯২৩-২৪ সালের সিএস ম্যাপে জমিটি বিচার বিভাগের নামে রেকর্ড ছিল। এরপর কোন দলিলও হয়নি বা বিচার বিভাগ ওই জমি বারের কাছে বিক্রি করেনি। বিষয়টি উত্থাপন করে ৩০ ধারায় আপত্তির প্রেক্ষিতে সেটেলমেন্ট ২০১৭ সালে ১.৮৪৩ একর জমি ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বিচার বিভাগে’র পক্ষে রায় দেয়।
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পক্ষে নাজীরের করা অভিযোগ অস্বীকার করে বাগেরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ড. একে আজাদ ফিরোজ টিপু বলেন ১৯১৫ ও ১৯২৯ সালে বিচার বিভাগ বাগেরহাট বার লাইব্রেরিকে জমি দেয়। আমরা সেই জমিতে স্থাপনা তৈরি করে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আইনের বাইরে আমরা কিছুই করছি না।
তিনি আরও জানান, আমাদের সমিতির সদস্যদের জায়গার সংকুলান না হওয়ায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছে নতুন ভবন করতে অর্থ বরাদ্দ চাইলে তিনি চার কোটি ৪৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেন। আমরা সেই টাকা দিয়ে পুরাতন কোর্ট এলাকায় একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণ করছি। এটা আমাদের আইনজীবী সমিতির সদস্যদের সম্মিলিত সিন্ধান্ত। আমার একক কোন সিদ্ধান্ত না।
বিচার বিভাগের জমি পাওয়ার শর্ত লঙ্ঘন করে একের পর এক ভবন নির্মাণ করার বিষয়ে জানতে চাইলে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি এই আইনজীবী নেতা।
Leave a reply