চাকরি দেয়ার কথা বলে ২০০৫ সালের ৭ অক্টোবর এক কিশোরীকে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় কিশোরীর মামা বাদী হয়ে মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০০৬ সালের ১৩ জুন এ মামলায় আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয় পুলিশ। ২০০৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আসামির বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) গঠন করেন আদালত।
২০০৮ সালের ৩ জানুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। মামলায় ৯ জনের মধ্যে ৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। সর্বশেষ ২০১০ সালের ১৫ জুন মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ হয়। এরপর আর কোনো সাক্ষ্য নেয়া হয়নি। আদালত ‘সময় ও অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা’ জারির পরও মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ‘চিকিৎসক এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা’ সাক্ষ্য দেননি। ইতোমধ্যেই মামলার একমাত্র আসামি মাসুম বিল্লাহ জামিন নিয়ে পলাতক আছে।
অপর এক মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এক কিশোরীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে আসামি শাহ আলম। একপর্যায়ে কিশোরী গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এ কারণে শাহ আলমকে বিয়ের জন্য চাপ দেয় ওই কিশোরী।
কিন্তু শাহ আলম বিয়ে না করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ভিকটিম নিজেই বাদী হয়ে ২০০৮ সালের ১৪ জুলাই মামলা করেন। ওই বছরের ৩০ আগস্ট মামলার চার্জশিট দেয়া হয়। একই বছরের ২৭ নভেম্বর আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের মাধ্যমে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। তবে এ দীর্ঘদিনেও মামলায় একজনেরও সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি।
মামলার বাদী, বাদীর মা এবং বাদীর বাবাকে সাক্ষীর জন্য স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায় সমন ও জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা পাঠানো হলেও তা কাজে আসেনি। পুলিশ আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে জানিয়েছে, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানায় তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে চাঞ্চল্যকর এ মামলার ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তায় পড়েছে। মামলার একমাত্র আসামি পলাতক রয়েছে।
দুটি মামলাই বর্তমানে ঢাকার দুই নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে। আগামী বছরের ২০ জানুয়ারি মামলা দুটির পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
শুধু এ দুটি মামলাই নয়, বর্তমানে দেশে ৯৫টি ট্রাইব্যুনালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে প্রায় পৌনে দুই লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৪০ হাজার মামলা ৫ বছরের পুরনো। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে প্রত্যেকটি ট্রাইব্যুনালে গড়ে প্রায় ১ হাজার ৭৫০টি মামলা বিচারাধীন।
একজন বিচারকের পক্ষে এসব মামলায় দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কঠিন। এতে একদিকে যেমন ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন না হওয়ায় ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে।
জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, বিদ্যমান আইনের অনেক কিছু পরিবর্তন দরকার। যদিও আমাদের পর্নোগ্রাফি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আছে। এরপরও পুরনো ব্রিটিশ আমলের সেই আইন ফলো করে কাজ করতে হচ্ছে। একটি আইনের প্রয়োগের ব্যাপারে তিনটি গ্রুপকে কাজ করতে হয়।
প্রথম হল তদন্ত। এ সময়ে একজন যোগ্য ও সৎ পুলিশ অফিসার যদি স্বাধীনভাবে তদন্ত করেন এবং তাকে যদি তার ঊর্ধ্বতন অফিসার নজরদারিতে রাখেন তাহলে একটি সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া সম্ভব। বর্তমান আধুনিক যুগে ডিএনএ টেস্ট, মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হলেন যথাক্রমে বিচারক এবং পাবলিক প্রসিকিউটর। একজন বিচারক যদি কমিটেট থাকেন এবং নারীবন্ধব হন, সেই সঙ্গে পাবলিক প্রসিকিউটর যদি তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন তাহলে বিচার সুষ্ঠু ও দ্রুত হওয়া সম্ভব।
এ তিনটি গ্রুপের যথাযত কাজের মাধ্যমেই একটি ভালো বা প্রত্যাশিত রায় আসতে পারে। এছাড়া হাইকোর্টের নীতিমালা মনিটর করা হলে যার যতটুকু অপরাধ- সে অনুসারে শাস্তি হতে পারে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের অধিকাংশ মামলায়ই সাজা হয় না। মাত্র ৫ ভাগ মামলায় সাজা হয়ে থাকে।
তাই আইন পরিবর্তনের চেয়েও সবচেয়ে বড় হল বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো। আর এসব বিচারক হতে হবে নারী ও শিশুবান্ধব। একই সঙ্গে সাক্ষী নিশ্চিত করাসহ আদালতে সব ধরনের সুবিধা বাড়াতে হবে।
বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সর্বোচ্চ ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে দাখিলের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। প্রতি কর্মদিবসে টানা বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করে মামলা নিষ্পত্তি করতে ট্রাইব্যুনালকে নির্দেশনা দেয়া আছে। ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ সম্পাদনের নির্দেশনাও আছে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন।
জানতে চাইলে ঢাকার তিন নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদা আক্তার বলেন, প্রতিটি কোর্টে প্রায় দুই হাজার নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলা রয়েছে। এরপরও পৃথক শিশু আদালত গঠন না হওয়া পর্যন্ত শিশুদের নিয়ে মামলাগুলোর বিচার কাজও এসব ট্রাইব্যুনালে হচ্ছে। ফলে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তিতে বিচার ও প্রসিকিউটরদের ওপর চাপ আরও বেড়ে গেছে।
ট্রাইব্যুনালসংক্রান্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বেশকিছু মামলায় ট্রাইব্যুনালে স্টাফদের সঙ্গে যোগসাজশে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে সাক্ষী হাজির হতে দেন না। ফলে বাদীপক্ষের লোকজন জানতেই পারে না যে কবে মামলার সাক্ষী হবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বাদীপক্ষের আইনজীবী আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে মিশে যান।
Leave a reply