”তুমি অমন করে গো বারে বারে জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না, জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না। ঐ কাতর কণ্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না, শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না।” কাজী নজরুলের এমন বিদায়ী লেখার মাঝে স্মরণে আসে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক পরিচিত মুখ, যার সমান পদচারণা ছোট পর্দায়ও। তিনি অভিনেতা হুমায়ুন সাধু। আজকের এই দিনে ভক্তদের কাঁদিয়ে যে চলে গিয়েছেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে।
গত বছরের এই দিনে পরলোকগমন করেন পরিচালক মোস্তফা সরোয়ার ফারুকির মেইড ইন বাংলাদেশ খ্যাত অভিনেতা হুমায়ুন কবির সাধু। অভিনয় করেছেন চোরাবালি সিনেমার বিশেষ দৃশ্যে। পর্দা ভাগ করে নিয়েছেন এটিএম শামসুজ্জামানের মত নামকরা অভিনেতার সাথেও।
অভিনয় জগতে সাধুকে ভিন্নভাবে দেখা হয় তার উচ্চতার কারণে। স্বাভাবিক মানুষের আকার ছিলো না সাধুর। কারণ উচ্চতায় সাধু ছিলেন চার ফুটের কাছাকাছি। তবে অভিনয় দক্ষতা দিয়ে যে মানুষটা হিমালয় ছুয়েছিলেন। জয় করেছেন লাখো ভক্তের হৃদয়।
অভিনয়ের পাশাপাশি সাধু দক্ষতা দেখিয়েছেন পরিচালনায়ও। ‘চিকন পিনের চার্জার’ নাটকের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন পরিচালনায়। কমেডিতে ভরপুর এই নাটক দর্শকমহলে বেশ প্রশংসা কুড়ায়।
তবে সাধুর আলোচিত কাজের ভেতরে উল্লেখযোগ্য ‘ঊন মানুষ’ টেলিফিল্ম। যেখানে সাধুর আকারের মানুষদের নিয়েই সাজানো হয় মূল গল্প। উন মানুষে অভিনয় করে বেশ পরিচিতি পান সাধু। আর নাট্য অভিনেতা হিসেবে তিনি একাধিক নাটক ও টেলিফিল্মে অভিনয় করেছেন।
চট্টগ্রামে ১৯৮২ সালের ১ মে জন্মগ্রহণ করেন সাধু। ৯ ভাইবোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। মায়ের সাথে সিনেমা দেখতে দেখতে ছোটবেলায় সাধু সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখতেন। মায়ের অনুপ্রেরণা সাধুর চলচ্চিত্রে প্রবেশে পাথেয় হিসেবে কাজ করে। দৈহিক গঠনে ছোট হওয়ায় তার বাবা স্কুলে পাঠাতে চাইছিলেন না। তার বড় বোনের কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ে শিক্ষকরা তাকে নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। বড় ভাই সাইফুল কবীর তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের ছাত্র। তিনি আবার হুমায়ূনকে সেই স্কুলে নিয়ে যান এবং প্রথম সাময়িক পরীক্ষা পর্যন্ত তাকে সুযোগ দেয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাধু ২য় শ্রেণিতে ১৩০ জন ছেলে-মেয়েকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হন।
হুমায়ূন সাধু এসএসসি পাসের পর নাসিরাবাদ কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন। এরমধ্যে প্রচুর পরিমাণ চলচ্চিত্র দেখার নেশায় এইচএসসির রেজাল্ট তেমন ভালো হয়নি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হন তিনি।
কর্মজীবন শুরুর প্রাক্কালে ঢাকার বিভিন্ন রেলস্টেশনে, বাসস্টেশনে ঠিকানাহীনভাবে কিছুকাল কাটান সাধু। এরপর চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকির সাথে পরিচয় ও তার সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে অভিনয় জগতে কাজ শুরু করেন। এছাড়া লেখক হিসেবে বইমেলায় প্রকাশ পায় তার প্রথম গল্পের বই ‘ননাই’।
রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে গত বছরের ২৫ অক্টোবর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই অভিনেতা। তেজগাঁওয়ের রহিম মেটাল জামে মসজিদে তার প্রথম জানাজা হয়, আসরের পর সেখানেই হয় দ্বিতীয় জানাজা। এরপর মসজিদসংলগ্ন কবরস্থানেই তাকে দাফন করা হয়। ‘ছবিয়াল’-এর সহকর্মীসহ শোবিজের অনেকেই অংশ নেন এই অভিনেতার জানাজায়।
গত বছরের ১৩ অক্টোবর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সাধুকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকরা জানতে পারেন তার ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে। ২০ অক্টোবরে আবারও স্ট্রোক করলে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর পর থেকেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন লাইফ সাপোর্টে।
Leave a reply