Site icon Jamuna Television

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা: গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি

গৃহস্থালির সেবামূলক কাজে নারীদের অংশগ্রহণের স্বীকৃতি এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় তার সুদূরপ্রসারী প্রতিফলনের সম্ভাব্যতা নিয়ে একশনএইড বাংলাদেশ ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম- এর যৌথ উদ্যোগে গতকাল মঙ্গলবার (১০ নভেম্বর) ‘অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা: গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি’ শিরোনামে একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়।

ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য সিনিয়র সচিব ড. শামসুল আলম। আলোচনায় নারীর গৃহস্থালি সেবামূলক কাজকে হিসাবে আনা কঠিন না হলেও তা মূল্যায়িত না হওয়ার জন্য স্বীকৃত পদ্ধতির অভাবকে কারণ হিসেবে দেখান তিনি। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটিতে গৃহস্থালির কাজ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সমাজের বিরাট একটি অংশ নিয়োজিত এ কাজে। প্রধানমন্ত্রীও একবার বলেছিলেন- এ কাজের মূল্যায়ন করা যায় না? বিষয়টি তিনি অবহিত। এটার মূল্যায়ন হওয়া উচিত। কিন্তু কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করবো, এখানে এসেই আলোচনা শেষ হয়ে যায়। স্বীকৃত কোনো পদ্ধতি আমাদের হাতে আসেনি। জাতিসংঘ বা আমরা যদি নীতিগতভাবে একমত হই, তখন এটি মূল্যায়ন করা যাবে।

ড. শামসুল আলম বলেন, জাতিসংঘ প্রণীত পদ্ধতি ন্যাশনাল ইনকাম অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আমরা জিডিপি গণনা করে থাকি। যেটা সারা বিশ্বেই অনুসরণ করা হয়। আর বাজার বিনিময়ের মাধ্যমে হাত বদল হওয়া পণ্য ছাড়া অন্য কিছু জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ নেই। আর্থিক মূল্যায়ন করতে চাইলে একটি পদ্ধতি আমাদের হাতে দিতে হবে। পথ-পন্থা পেলে এটি উল্লেখ করবো না কেন? আমাকে গুছিয়ে কিছু দিতে পারলে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এর প্রতিফলন ঘটাতে অসুবিধা নেই।

২০১৪ সালের সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)- এর এক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ঘরের কাজে নারীরা যে সময় ব্যয় করে সেটা যদি বাইরের কাজে করে, সেটার মূল্য হবে বাইরে যে কাজ করা হয়, তার চেয়ে আড়াই গুণ বেশি। নারী ঘরের কাজটি না করে অন্য কাউকে নিয়োগ দিলে তাকে অর্থ দিতে হয়, এটা হচ্ছে রিপ্লেসমেন্ট কস্ট। আর নারী এ কাজটির জন্য কত টাকা নিবে, সেটা হচ্ছে উইলিংনেস টু একসেপ্ট। এ দুই পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। যা পরোক্ষ।

একশনএইড ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়ার অ্যাডভোকেসি কো-অর্ডিনেটর মো. হেলাল উদ্দিন লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও দিনাজপুরের নারী-পুরুষের সময় ব্যয় নিয়ে সংস্থাটির এক সমীক্ষা তুলে ধরে জানান, ২০১৬ সালে নারীরা ৭ দশমিক ৭৮ ঘণ্টা গৃহস্থালির মজুরিবিহীন সেবামূলক কাজ করেছেন, সেখানে পুরুষরা করেছেন ১ দশমিক ১ ঘণ্টা। ২০১৭ সালে নারী ও পুরুষের গৃহস্থালি কাজের এই ব্যবধান ছিল ৫ দশমিক ১৯ ঘণ্টা, যা ২০১৮ সালে ৩ দশমিক ৭৫ ঘণ্টা ও ২০১৯ সালে ৩ দশমিক ৪৩ ঘণ্টায় দাঁড়ায়। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি পুরুষদের কাজটিতে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে তারা কাজটিকে মূল্যায়ন করেন এবং এতে সহযোগিতা করেন।

গণমাধ্যমে নারীর গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়ে প্রচারণার তাগিদ দিয়ে ওয়েবিনারে সভাপতির বক্তব্যে একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, গৃহস্থালির কাজের স্বীকৃতি বলতে বোঝানো হচ্ছে নারী যে গৃহস্থালির কাজগুলো করছেন, নারীর অবস্থান তৈরি করা, সমাজে তার কাজের মূল্য পাওয়া। পুরুষ যেভাবে বেড়ে উঠেছে, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় সেখানে গৃহস্থালির কাজ করতে গিয়ে একটা বাধার তৈরি হয়। সেখানে গণমাধ্যম একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

ওয়েবিনারে প্যানেল আলোচক হিসেবে আরও অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন, মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির, অভিনেত্রী ও শিক্ষক ত্রপা মজুমদার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন বলেন, গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়ন না হওয়ায় পুরুষও পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে তৈরি হচ্ছে না। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হচ্ছে, ইমপ্রুভ উইমেনস হিউম্যান ক্যাপাবিলিটিস, সেখানে আমরা মেনস হিউম্যান ক্যাপাবিলিটিস ইমপ্রুভের চিন্তা করছি না কেনো? কেননা নারী গৃহস্থালির যে কাজগুলো করেন, সেগুলো তো নারীর কাজ। এই কাজগুলো যারা করেন, তারা মানবীয় কাজ করেন। পুরুষরা যখন সে কাজগুলো না করেন, তখন তো তারা হিউম্যান হয়ে উঠছেন না।

এর ভিন্ন প্রভাব তুলে ধরে তিনি বলেন, অবমূল্যায়িত কাজ শুধু তার চাপই বাড়াচ্ছে না, অন্যান্য কাজ থেকে তাকে বিরতই রাখছে না; একই সাথে এর সাথে নির্যাতনের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়ন না হওয়ায় ‘নারী কাজ করছে না’ বলে যে ধারণা তৈরি হয়েছে, তা সমাজে বৈষম্য বাড়াচ্ছে।

মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির বলেন, পুরুষরা গৃহস্থালির কাজ করতে গেলে মনে করত, গ্রামের মানুষরা তাকে টিটকারি দিবে, তাদেরকে গ্রহণ করা হবে না। তারা যদি দরিদ্র শ্রেণির হয়, এই কাজে যোগদান করতে পারবে না। এখন অনেক ক্ষেত্রে এই চিন্তাটার পরিবর্তন আসতে শুরু করছে।

নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের আলোচনায় পুরুষদেরও সক্রিয় অংশগ্রহণের তাগিদ দিয়ে অভিনেত্রী ও শিক্ষক ত্রপা মজুমদার বলেন, আর কতদিন আমরাই আমাদের কথা বলবো? এখানে পুরুষদের কথা বলতে হবে। পুরুষরা শুধু শুনবেন, আর বাড়িতে গিয়ে একই কাজ করবেন, তাহলে পরিবর্তনটা কখনোই নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। বাইরে যতই অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক না কেনো, বাড়ি ফিরে আমি যদি নিজের অধিকার নিজে নিশ্চিত করতে না পারি, সব ধরনের অধিকার সেখানে ধুলোয় মিশে যায়।

অনুষ্ঠানে প্রকল্প অংশীদার হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন লালমনিরহাট জেলার লাইজু বেগম ও গাইবান্ধার লাকি বেগম।

ইউএইচ/

Exit mobile version