ইব্রাহিম খলিল:
সিইসি কে এম নুরুল হুদাসহ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ এনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্তের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানিয়েছেন ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক। কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান এখনো বলবৎ আছে কিনা তা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন সাংবিধানিক বিতর্ক।
গেলো সোমবার রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেছেন, এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান নেই। কারণ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন বহাল রাখার আপিল বিভাগের রায়টির বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। যেটি শুনানির অপেক্ষায়, ফলে সাংবিধানিকভাবে এ ধরনের কাউন্সিল করার সুযোগ নেই রাষ্ট্রপতির।
এখন সাংবিধানিক পদের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের সুরাহা কীভাবে হবে- জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এখন কোনো অভিযোগ এলে রিভিউ শুনানি শেষ করার পর সিদ্ধান্ত হবে কোন প্রক্রিয়ায় তদন্ত হবে।’
এক্ষেত্রে সাংবিধানিক কোনো শূন্যতা বিরাজ করছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, সাংবিধানিক শূন্যতা নেই, তবে প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা আছে, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আছে। ওনারা করতে পারেন। কোর্ট খোলার পরেই এটা শুনানির উদ্যোগ নেয়া হবে। রিভিউ যেহেতু পেন্ডিং আছে, এ অবস্থায় কিছুই বলতে পারব না।’
রিভিউয়ের সময় আদালত রায়ে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল কিনা- জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘রিভিউ করলে স্থগিত করার দরকার হয় না। এমনিতেই রিভিউ শুনানি না হওয়া পর্যন্ত রায় স্থগিত থাকবে, যেহেতু এর কোনো চূড়ান্ত পরিণতি হয়নি।’
তবে সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অবশ্যই বলবৎ আছে। 71 DLR (AD) 52, page 318 এ Order XXIV of the Supreme Court if Bangladesh (Appellate Division) Rules, 1988 এর রেফারেন্স উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এখনও আছে কারণ ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের রায়টি স্থগিত আদেশ নেই। শুধুমাত্র মৃত্যুদণ্ড ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষেত্রে রিভিউ ফাইল করলেই এটা ‘অটোমেটিক স্টে’ হয়ে যায় না। এটাই আপিল বিভাগের রুলস।
তবে দুদকের মুখ্য আইনজীবী খুরশিদ আলম খান ভিন্ন মত পোষণ করে তিনি বলেন, সাংবিধানিক বিতর্কের ক্ষেত্রে এই রুলস কাজ করবে না। তিনি “৪২ বিশিষ্ট নাগরিক” এই শ্রেণি বিভাজন ও বিশেষণ নিয়েও আপত্তি জানান। তিনি বলেন, সংবিধান ও আইনের চোখে কোনো “বিশিষ্ট নাগরিক” বলে কিছু নেই, সবাই সমান। তিনিও মনে করেন, এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান নেই, তাই সাংবিধানিকভাবে এ ধরনের কাউন্সিল করার সুযোগ নেই রাষ্ট্রপতির। তিনি আরও মনে করেন, এখন একটি সাংবিধানিক শূন্যতা বিরাজ করছে।
অন্যদিকে সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের সাথে একমত পোষণ করে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ মনে করেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন গ্রহণের সময়ে আপিল বিভাগে রায়টি যেহেতু স্থগিত করা হয়নি সেহেতু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান এখনও বিদ্যমান। তিনি মনে করছেন, ‘রিভিউ আবেদন করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রায় স্থগিত হয়ে যায় না। ষোড়শ সংশোধনীর মামলায় রিভিউ আবেদনে আবেদনকারীদের রায়টি স্থগিত করার বিষয়টি চাইতে হবে। আদালতকেও স্থগিতাদেশ দিতে হবে। যদি আদালত স্থগিত করে থাকে তাহলে রায় নাই, আর স্থগিত না করলে বিদ্যমান আছে।’
আইন বিশ্লেষক ড. শাহদীন মালিকও একই ধরনের মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘সংবিধানে বিচারপতিদের বিষয়ে বলা আছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে অপসারিত হবেন। নির্বাচন কমিশন চ্যাপ্টারে বলা আছে বিচারপতিরা যেভাবে অপসারিত হন, নির্বাচন কমিশনারও সেভাবে অপসারিত হবেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ব্যাপারেও বলা আছে, কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের বিষয়েও ঠিক একইভাবে বলা আছে।’
সম্প্রতি হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতিকে আর বেঞ্চ দেয়া হয়নি। তারা ছুটিতে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে কিনা? সেটা কারা তদন্ত করছে? তাদের বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কাজ করছে কিনা সেটি অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তথ্যের ঘাটতি রয়ে গেছে। ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
সর্বোপরি রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়ায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের পুরো বিষয়টিকে ঘিরে রয়েছে অস্পষ্টতা।
লেখক: আইন ও আদালত প্রতিবেদক।
Leave a reply